বেকারত্ব মোচনে পথনকশা চাই

সম্পাদকীয়

যেখানে বেকারত্বের সংজ্ঞা নিয়েই গোলমাল, সেখানে বেকারের সংখ্যা নিরূপণ করা কঠিন। আইএলওর সংজ্ঞা অনুযায়ী, সপ্তাহে যাঁরা এক ঘণ্টা উপার্জন করেন, তাঁদেরও কর্মরত হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু বাংলাদেশ তো বটেই, পৃথিবীর কোনো দেশেই সপ্তাহে এক ঘণ্টা কাজ করে কেউ চলতে পারেন না।

তারপরও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) আইএলওর সংজ্ঞা মেনে বেকারের সংখ্যা নিরূপণ করে থাকে, যা অবিশ্বাস্য! বিবিএসের হিসাবে ২০২৪ সালের জুলাই–সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে ২৬ লাখ ৬০ হাজার মানুষ বেকার ছিলেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আর হিসাবটি প্রস্তুত করা হয়েছে ১৯তম আইসিএলএস (পরিসংখ্যানবিদদের আন্তর্জাতিক সম্মেলন) অনুযায়ী। এ পদ্ধতি অনুসারে যাঁরা উৎপাদনমূলক কাজে নিয়োজিত থাকেন, কিন্তু বাজারে পণ্য বা সেবা বিক্রি করেন না, তাঁরা কর্মে নিয়োজিত নন হিসেবে ধরা হয়। তাঁরা বেকার জনগোষ্ঠী হিসেবে বিবেচিত হন। এই হিসাবে গৃহকর্মে নিয়োজিত বিরাটসংখ্যক নারীও বেকারের তালিকায় আসবেন, যাঁরা আগের হিসাবে বাদ পড়েছেন। পুরোনো হিসাবে সেপ্টেম্বর মাস শেষে দেশে বেকারের সংখ্যা দাঁড়ায় ২৫ লাখ ৫০ হাজার।

বিবিএসের জরিপে বলা হয়েছে, সার্বিকভাবে বেকার জনগোষ্ঠী মূলত তাঁরাই, যাঁরা জরিপের আগের সাত দিন সময়ে এক ঘণ্টাও কোনো কাজ করেননি, কিন্তু কাজ করার জন্য প্রস্তুত ছিলেন। একই সঙ্গে তাঁরা জরিপের পরের দুই সপ্তাহেও কাজের জন্য প্রস্তুত ছিলেন। এ ছাড়া বিগত ৩০ দিনে বেতন বা মজুরি অথবা মুনাফার বিনিময়ে করার জন্য কোনো না কোনো কাজ খুঁজেছেন—এমন ব্যক্তিরা বেকার হিসেবে বিবেচিত হন। এই নীতি মেনে নিলে বাংলাদেশে বেকারের সংখ্যা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে?

১৩তম আইসিএলএসের ভিত্তিতে বিবিএসের ত্রৈমাসিক জরিপ অনুযায়ী, গত সেপ্টেম্বর মাস শেষে দেশের শ্রমশক্তি ছিল ৭ কোটি ৬ লাখ। এর মধ্যে পুরুষ ৪ কোটি ৭৪ লাখ ৯০ হাজার এবং নারী ২ কোটি ২৫ লাখ ৭০ হাজার।

বিবিএস যখন পুরোনো ও নতুন হিসাব নিয়ে গলদঘর্ম অবস্থায়, তখন দেশে চাকরির বাজারটি কেমন? প্রতিবছর ২০ থেকে ২২ লাখ মানুষ চাকরির বাজারে প্রবেশ করেন। তাঁদের মধ্যে ১৩ থেকে ১৪ লাখ মানুষের দেশে কর্মসংস্থান হয়। অন্যরা কোথায় যাবেন? সাম্প্রতিক কালে দেশের বাইরে বাংলাদেশি শ্রমিকদের কাজের সুযোগ কমে যাচ্ছে। ২০১৪ সালে প্রবাসী শ্রমিক গেছেন আগের বছরের চেয়ে তিন লাখ কম। দেশে যথাযথ কর্মসংস্থান নেই বলেই হাজার হাজার চাকরিপ্রার্থী মহা অনিশ্চয়তা নিয়েও বিদেশে যান। অনেকে দালালদের খপ্পরে পড়ে সর্বস্বান্ত হন।

গত জুলাই–আগস্টের গণ–অভ্যুত্থানের পর থেকে দেশে একধরনের রাজনৈতিক অস্থিরতা চলছে, যার অভিঘাত এসে পড়েছে অর্থনীতিতেও। বিজিএমইএর হিসাব অনুযায়ী ১০০ তৈরি পোশাক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। মাঝেমধ্যেই শ্রমিক অসন্তোষ চলছে।

এ অবস্থায় বিবিএসের অবিশ্বাস্য পরিসংখ্যানের ওপর নির্ভর করে সরকারের নিশ্চিন্ত থাকার সুযোগ নেই। নীতিনির্ধারকদের উচিত হবে অবিলম্বে শিল্পাঞ্চলে বিনিয়োগের অনুকূল পরিবেশ নিশ্চিত করা। নিরবচ্ছিন্ন করতে হবে গ্যাস–বিদ্যুতের সরবরাহও। সরকারকে মনে রাখতে হবে, দেশে কর্মক্ষম মানুষের বিরাট অংশকে কর্মহীন রেখে দেশের কোনো সংস্কারকাজই এগিয়ে নেওয়া যাবে না। অতীতে আওয়ামী লীগ সরকার বেকারত্বের মতো গুরুতর সমস্যাকেও আমলে নেয়নি; আশা করি অন্তর্বর্তী সরকার একই পথে হাঁটবে না। কর্মসংস্থানের বিষয়েও সরকারের একটি সুনির্দিষ্ট পথনকশা থাকা প্রয়োজন বলে মনে করি।