জ্বালানি খাতের অপচয়–দুর্নীতি বন্ধ হোক

সম্পাদকীয়

ভর্তুকির চাপ সামলাতে সরকার বছরে চারবার বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সফররত আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠকে সরকারের নীতিনির্ধারকেরা এ সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দেন। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ গত ফেব্রুয়ারিতে বলেছিলেন, ঘাটতি মেটাতে দাম সমন্বয় করা হচ্ছে। আগামী তিন বছর ধাপে ধাপে দাম সমন্বয় করা হবে। গত বছর তিনবার ও চলতি বছর একবার সরকার বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছে।

সরকারের এ ধরনের পদক্ষেপে আইএমএফ খুশি হলেও দেশের মানুষের খুশি হওয়ার কোনো কারণ দেখি না। আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো বরাবর ভর্তুকি দেওয়ার বিপক্ষে এবং তারা প্রায় সব উন্নয়নশীল দেশের জন্য অভিন্ন ব্যবস্থাপত্র দিয়ে থাকে। এই ব্যবস্থাপত্রে অনেক দেশের অর্থনীতি ডুবলেও তাদের কিছু আসে যায় না।

বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয় সামলানোর দুটি উপায় আছে। প্রথমত, উৎপাদন খরচ কমানো। দ্বিতীয়ত, ভোক্তার ওপর চাপ বাড়ানো। বিদ্যুৎ বিভাগের কর্তাব্যক্তিদের নজর দ্বিতীয়টির প্রতিই। কিন্তু বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ কেন বাড়ল, কেন জ্বালানি খাত ক্রমেই পরনির্ভরশীল হয়ে পড়ল, সেসব প্রশ্নের জবাব নেই।

সরকার যখন বছরে চারবার বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তখন বাস্তব অবস্থা কী? প্রথম আলোর খবর থেকে জানা যায়, কোনো কোনো দিনে প্রায় তিন হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ ঘাটতি থাকে, যা সমন্বয় করা হয় লোডশেডিং দিয়ে। আবার এই লোডশেডিং করার ক্ষেত্রেও বৈষম্য আছে। ঢাকা শহরের চেয়ে গ্রামাঞ্চলে লোডশেডিংয়ের মাত্রা বেশি। গাজীপুরের কোনো কোনো কারখানায় দিনে ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকে না। এ অবস্থায় শিল্পকারখানার উৎপাদন যে মারাত্মকভাবে হ্রাস পাচ্ছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

বিদ্যুৎ খাতে যে সরকার বছরে ৪০ হাজার কোটি টাকার মতো ভর্তুকি দিচ্ছে, তার জন্য দুর্নীতি, অপচয় ও ভুল নীতিও কম দায়ী নয়। সরকার দেশি গ্যাস অনুসন্ধান না করে জ্বালানি খাতকে আমদানিনির্ভর করে ফেলেছে। এখন আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির দাম বেড়ে যাওয়ায় ভর্তুকি গুনতে হচ্ছে। তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো পাঁচ বছরের জন্য চালু রাখার কথা থাকলেও সরকার সেটি ১৫ বছরে নিয়ে এসেছে। জ্বালানির নিশ্চয়তা ছাড়াই একের পর এক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে চুক্তি করেছে।

এখন আমাদের চাহিদার চেয়ে উৎপাদন সক্ষমতা প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। বসিয়ে রাখতে হলে এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য বছরে হাজার হাজার কোটি টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ (কেন্দ্র ভাড়া) দিতে হচ্ছে। এতে বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ বেড়েছে। এই অপচয় কিংবা ভর্তুকির দায় ভোক্তারা কেন নেবেন?

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম প্রথম আলোকে বলেন, কল্পিত উচ্চ চাহিদা দেখিয়ে কিছু বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে এবং তাদের ক্যাপাসিটি চার্জ দেওয়া হচ্ছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে পিডিবি ২৬ হাজার কোটি টাকার বেশি খরচ করেছে বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভাড়া পরিশোধে।

ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) বলেছে, অনিয়ম, অপচয়, দুর্নীতি কার্পেটের নিচে রেখে মূল্যবৃদ্ধি ভোক্তার প্রতি সুবিচার নয়।

বিদ্যুৎ এমন একটি পরিষেবা, যার সঙ্গে দেশের সার্বিক অর্থনীতি তথা শিল্প ও কৃষির উৎপাদনশীলতা সরাসরি যুক্ত। বিদ্যুতের দাম বাড়ালে পণ্যের উৎপাদন খরচও বাড়বে, যা কোনোভাবে কাম্য নয়। আবার বাংলাদেশের মতো বিকাশমান অর্থনীতির দেশে বিদ্যুতের ভর্তুকি পুরোপুরি প্রত্যাহার করাও সমীচীন হবে না। বিদ্যুতের ঘাটতি কমাতে পারলে মেগাওয়াটভিত্তিক উৎপাদন খরচও কমে যাবে। তাই দফায় দফায় দাম না বাড়িয়ে সরকারের উচিত বিদ্যুৎ খাতে বিদ্যমান অপচয়, অনিয়ম ও দুর্নীতি বন্ধ করা।