জনদুর্ভোগ বাড়ানোর কর্মসূচি নয়

সম্পাদকীয়

দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিরোধী দল বিএনপি প্রায় প্রতিদিনই ঢাকা শহরে কর্মসূচি পালন করে আসছে। গণতান্ত্রিক সমাজে যেকোনো রাজনৈতিক দল বা সংগঠন তার নীতি-পরিকল্পনার কথা জনগণের কাছে তুলে ধরতে সভা-সমাবেশ করতে পারে। কিন্তু এখানে দেখার বিষয়, সেই সভা-সমাবেশের নামে যেন জনগণের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত না হয়।

দেড় কোটি জন-অধ্যুষিত ঢাকা শহরে যেখানে নিত্য যানজট লেগে থাকে, সেখানে একই দিন দুই বড় দলের সমাবেশ থাকলে পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ হতে পারে, কয়েক মাস ধরে নগরবাসী হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন। আগে ঢাকা শহরে রাজনৈতিক কর্মসূচি থাকত মাসে দু-একবার।

সাম্প্রতিক কালে বলতে গেলে প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো কর্মসূচি থাকছে। রাজনৈতিক কর্মসূচির বাইরে বিভিন্ন পেশাজীবীরাও দাবিদাওয়া আদায়ে মাঠে নেমেছেন। এর সঙ্গে ভিআইপি ও ভিভিআইপি চলাচল পরিস্থিতিকে শোচনীয় করে তুলেছে।

কর্মদিবসে অফিস-আদালত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কলকারখানা, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান খোলা থাকে। এসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট লাখ লাখ মানুষ সকালে কর্মস্থলে যান এবং দিনের শেষে ঘরে ফেরেন। স্বাভাবিক অবস্থায় যানজটের কারণে তাঁদের কয়েক ঘণ্টা রাস্তাতেই থাকতে হয়। এ পরিস্থিতিতে ঢাকায় বড় সমাবেশ থাকলে কী ভয়াবহ অবস্থা সৃষ্টি হয় উপলব্ধি করা কঠিন নয়। বিকেলে অফিস থেকে রওনা দিয়ে অনেক রাতে ঘরে ফিরতে হয় দূরগামী যাত্রীদের। সম্প্রতি এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে আংশিক চালু করায় যানজট কমার বদলে শহরের একটি অঞ্চলে রীতিমতো অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে।

রাজনৈতিক দলগুলো জনগণের জন্য রাজনীতি করে। নেতারাও প্রতিটি বক্তৃতায় জনগণের প্রতি তাঁদের দরদ ও কর্তব্যবোধের কথা সগর্বে উচ্চারণ করেন। অথচ তাঁদের কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে যদি সেই জনগণই যে চরম দুর্ভোগ ও হয়রানির শিকার হচ্ছেন, তা কি একবারও তাঁরা ভেবে দেখেছেন?

কোনো দায়িত্বশীল রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও দল এ কাজ করতে পারে না। এরপরও তারা নগরবাসীকে প্রায় জিম্মি করে দিনের পর দিন জনগণের ওপর ‘গণতান্ত্রিক অধিকার’ প্রয়োগ করে চলেছে। তাদের এ ‘গণতান্ত্রিক অধিকার’ প্রয়োগ জনগণের যন্ত্রণা ও ভোগান্তি আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।

নগরের যান চলাচল পরিস্থিতির এই অচলাবস্থার সঙ্গে ভিআইপি ও ভিভিআইপি চলাচল পরিস্থিতিকে কোথায় নিয়ে যায়, তা ভুক্তভোগী নগরবাসী হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন। এসব কারণে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সড়ক পুরো বন্ধ করে রাখা হচ্ছে, যার প্রভাব পড়ছে পুরো শহরে। এর বিকল্প কী হতে পারে, তা নিয়ে চিন্তাভাবনা প্রয়োজন।

যেকোনো শহরে সভা-সমাবেশ করার জন্য যে বড় মাঠ থাকা দরকার, সেই মাঠ ঢাকায় নেই। এ কারণে ব্যস্ত সড়ক বন্ধ করে রাজনৈতিক দলগুলো সভা-সমাবেশ করে থাকে। আগে কোনো রাজনৈতিক দল নির্দিষ্ট দিন সমাবেশ ডাকলে অন্য দল ওই সময় কর্মসূচি থেকে বিরত থাকত। কিন্তু সাম্প্রতিক কালে তারা এই রীতি ভেঙে একই দিনে শহরের দুই প্রান্তে কিংবা কাছাকাছি জায়গায় সমাবেশ করছে, যা কেবল জনদুর্ভোগ বাড়াচ্ছে না, অর্থনীতির গতিও থামিয়ে দিচ্ছে। মানুষের লাখ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে।

গণতান্ত্রিক সমাজে যেকোনো সমস্যা সমাধানের জন্য রাজপথের চেয়ে আলোচনার টেবিলই উত্তম স্থান। আর যদি কর্মসূচি পালন করতেই হয়, সেটি সাপ্তাহিক ছুটির দিনে করা হোক। আমরা আশা করব, ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দল এমন কোনো কর্মসূচি নেবে না, যাতে জনদুর্ভোগ আরও বাড়ে, দিন আনা দিন খাওয়া মানুষের রুটিরুজির পথ বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়।