জনস্বার্থে কথা বলা কি অপরাধ

সম্পাদকীয়

ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের কার্যক্রম নিয়ে শহরে পোস্টার সাঁটানোর দায়ে তরুণ কবি ও গ্রাফিক ডিজাইনার শামীম আশরাফকে প্রথমে ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার এবং পরে সাইবার নিরাপত্তা আইনে তাঁর বিরুদ্ধে মামলা দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এটা যেমন নিন্দনীয়, তেমনি উদ্বেগজনক।

প্রথম আলোর খবর থেকে জানা যায়, রোববার (১৮ ফেব্রুয়ারি) রাতে শামীম আশরাফকে শহরের আঠারোবাড়ি বিল্ডিং এলাকায় অবস্থিত তাঁর ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান থেকে আটক করে পুলিশ। একজন তরুণ কবিকে ফেব্রুয়ারিতে গ্রেপ্তার করা হলো, যে মাসে এ দেশের মানুষ জীবন দিয়ে ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তাঁর আটকের ঘটনায় ময়মনসিংহের লেখক–কবিরা প্রতিবাদ করেছেন। প্রতিবাদ এসেছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও।

এই প্রেক্ষাপটে মঙ্গলবার দুপুরে ময়মনসিংহের জ্যেষ্ঠ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মো. তাজুল ইসলাম সোহাগের আদালতে জামিনের আবেদন করা হলে শুনানি শেষে তাঁর জামিন মঞ্জুর করা হয়।

জামিন হওয়ার পর সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে শামীম আশরাফের নামে সাইবার নিরাপত্তা আইনে মামলা করা হয়। এতে বলা হয়, ৭ থেকে ১৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের লোগো ব্যবহার করে সিটি করপোরেশনের বিরুদ্ধে অপপ্রচারমূলক পোস্টার ডিজাইন করেন এবং সেসব পোস্টার নগরের বিভিন্ন এলাকায় সাঁটান। এ সময় তাঁর ব্যবহৃত কম্পিউটার ও অন্যান্য ডিভাইসে অপপ্রচারমূলক পোস্টারের ডিজাইন পাওয়া যায়।

সিটি করপোরেশনের পক্ষের আইনজীবী বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, সাইবার ট্রাইব্যুনাল আদালতের বিচারক বজলুর রহমান আবেদনটি আমলে নিয়ে যেকোনো তদন্তকারী সংস্থার মাধ্যমে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন। শামীম আশরাফ যানজট, জলাবদ্ধতাসহ ময়মনসিংহ নগরের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে কথা বলে আসছেন। ব্রহ্মপুত্র নদের হাঁটুপানিতে নেমে খননকাজে অনিয়মের ব্যতিক্রমী প্রতিবাদ করে সারা দেশে আলোচিত হন। এর অর্থ হচ্ছে তিনি ব্যক্তি বা গোষ্ঠীস্বার্থ নয়, বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর অধিকার আদায়ের জন্য আন্দোলন করে আসছেন।

সিটি করপোরেশনের পদাধিকারী যে–ই থাকুন না কেন, এটি কারও ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়, জনগণের প্রতিষ্ঠান। জনগণের করের অর্থে পরিচালিত প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম নিয়ে কথা বলার, সমালোচনা করার অধিকার সবার আছে।

শামীম আশরাফের লেখা বা ডিজাইন করা পোস্টারে যদি ‘শোষক নয়, সেবক চায় নগরবাসী’ কিংবা ‘হোল্ডিং ট্যাক্সের পাহাড়ের বোঝা কেন সাধারণ মানুষের ওপর চাপাও’ লেখা থাকে, সেটা ব্যক্তিবিশেষের বিরুদ্ধে কুৎসা হলো কীভাবে? সিটি করপোরেশন এলাকার নাগরিক সমস্যা ও উদ্বেগ নিয়ে পোস্টার সাঁটানো যাবে না, এমন কোনো আইন দেশে নেই। জনস্বার্থে কথা বলা কোনো যুক্তিতেই অপরাধ নয়।

অভিযোগ আছে যে শামীম আশরাফের বিরুদ্ধে সাইবার আইনে মামলা করার পেছনে ময়মনসিংহে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বও কাজ করেছে। গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শামীমের করা পোস্টার বিজয়ী প্রার্থীর পক্ষে এবং পরাজিত প্রার্থীর বিপক্ষে জনমত তৈরিতে ভূমিকা রাখে। এ কারণে নির্বাচনের পর পরাজিত প্রার্থী তাঁর কাছে কৈফিয়ত দাবি করেন। ওই পরাজিত প্রার্থী আর কেউ নন, সিটি করপোরেশনের সদ্য সাবেক মেয়র ও আগামী ৯ মার্চের নির্বাচনে মেয়র প্রার্থী ইকরামুল হকের ভাই।

আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ বিরোধের খেসারত কেন একজন তরুণ কবি ও গ্রাফিক ডিজাইনার দেবেন? আগে ক্ষমতাধরেরা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করেই অভিযুক্তকে চৌদ্দ শিকের ভেতরে ঢোকাতেন। সাইবার নিরাপত্তা আইনের অনেক ধারা জামিনযোগ্য হওয়ায় ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশন ওই আইনে মামলা করার আগে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তারের মন্দ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।

আমরা শামীম আশরাফের বিরুদ্ধে দায়ের করা এই হয়রানিমূলক মামলা অবিলম্বে প্রত্যাহারের দাবি জানাচ্ছি।