তথ্যের উৎস (সোর্স) প্রকাশ না করতে আইনগতভাবেই সাংবাদিকদের সুরক্ষা দেওয়া হয়েছে বলে এক রায়ে উল্লেখ করেছেন হাইকোর্ট। আদালত বলেছেন, ঘটনা, পারিপার্শ্বিকতা ও আইনি দিক পর্যালোচনা করে এটি বলতে দ্বিধা নেই যে সাংবাদিকদের তথ্যের উৎস প্রকাশ না করতে সুরক্ষা দিয়েছে আইন।
যে সময় সরকার স্বাধীন সাংবাদিকতার পরিপন্থী বিভিন্ন আইন গণমাধ্যমের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছে, সে সময়ে এই রায় সাংবাদিকদের নিঃসন্দেহে উৎসাহিত করবে এবং অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার ক্ষেত্রও প্রসারিত করবে। আমরা আদালতের এই রায়কে স্বাগত জানাই।
সাংবাদিক কোথা থেকে তথ্য পেলেন, সেটি বিবেচ্য বিষয় নয়। বিবেচ্য বিষয় হলো, তথ্যটি সত্য কি না। সাংবাদিকেরা যেহেতু জনগণের স্বার্থে তথ্য প্রকাশ করেন, সেহেতু তাঁরা তথ্যের উৎস জানাতে বাধ্য নন।
আদালতের রায়ে বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত এই সত্যই প্রতিধ্বনিত হয়েছে। উদ্বেগের বিষয় হলো স্বার্থান্বেষী চক্র তথ্যের উৎস জানানোর জন্য সাংবাদিকদের ওপর সব সময় চাপ দিয়ে থাকে। তথ্যের উৎস না জানানোয় অনেক সাংবাদিককে হয়রানি-নির্যাতনেরও শিকার হতে হয়। অন্যদিকে তথ্যের উৎস জানানো হলে তথ্যদাতা বিপদে পড়ার সমূহ আশঙ্কা আছে।
গত বছরের ২ মার্চ ‘দুর্নীতি দমনে “দুদক স্টাইল”: ২০ কোটিতে প্রকৌশলী আশরাফুলের দায়মুক্তি!’ শিরোনামে সহযোগী একটি দৈনিকে প্রকাশিত প্রতিবেদন নজরে আনা হলে হাইকোর্ট ওই বছরের ৮ মার্চ স্বতঃপ্রণোদিত আদেশ দেন। প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ থেকে হাউজিং অ্যান্ড বিল্ডিং রিসার্চ ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক আশরাফুল আলম ও তাঁর স্ত্রীকে অব্যাহতি দেওয়া হচ্ছে।
বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি কাজী মো. ইজারুল হক আকন্দের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ বছরের ২১ জুন রায় দিলেও পূর্ণাঙ্গ রায়টি প্রকাশ করা হয় গত রোববার। এর আগে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা অভিযোগের বিষয়ে অবস্থান জানাতে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যানকে নির্দেশ দিয়েছিলেন হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট বেঞ্চ।
একই সঙ্গে পত্রিকার সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদককে তথ্য-উপাত্ত হলফনামা আকারে দাখিল করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। এর ধারাবাহিকতায় চূড়ান্ত শুনানি শেষে হাইকোর্ট পর্যবেক্ষণ, নির্দেশনাসহ বিষয়টি নিষ্পত্তি করে রায় দেন। রায়ে আশরাফুল ও তাঁর স্ত্রীর বিরুদ্ধে অভিযোগ অনুসন্ধানে দুদকের আগের অনুসন্ধান কর্মকর্তাকে বাদ দিয়ে নতুন করে অনুসন্ধান করতে নির্দেশ দেওয়া হয়।
আদালত যথার্থই বলেছেন, দুর্নীতি ও দুর্নীতির চর্চা, মানি লন্ডারিংসহ জনস্বার্থ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ প্রকাশে সাংবিধানিক ও আইনগতভাবে এখতিয়ার রাখেন গণমাধ্যম ও সাংবাদিকেরা। সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদে চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা এবং বাক্স্বাধীনতার যে নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে, তা প্রতিপালন করতে হলে সাংবাদিকদের পেশাগত সুরক্ষা দিতেই হবে। আধুনিক বিশ্বে তথ্য জানার অধিকার মতামত প্রকাশের অন্যতম পূর্বশর্ত হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
এই রায়ে আদালত একই সঙ্গে হলুদ সাংবাদিকতা অননুমোদিত এবং আদৌ প্রশংসনীয় নয় বলে যে মন্তব্য করেছেন, আমরা তা পুরোপুরি সমর্থন করি। সাংবাদিকের দায়িত্ব সত্য প্রকাশ করা, মনগড়া কাহিনি ফাঁদা নয়। এ রকম হলুদ সাংবাদিকতা যাঁরা করেন, তাঁদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হোক, এটা সাংবাদিক সমাজেরই দাবি। আমাদের প্রত্যাশা, উচ্চ আদালতের ওই রায়ের পর অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার প্রতিবন্ধকতাগুলো দূর করতে সরকার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে।