আয় বাড়াতে হবে, কমাতে হবে বৈষম্য

সম্পাদকীয়

সম্প্রতি বৈশ্বিক খাদ্যনিরাপত্তা ও পুষ্টি পরিস্থিতি নিয়ে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থাসহ (এফএও) পাঁচটি আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিবেদনে বাংলাদেশের খাদ্য পরিস্থিতির যে চিত্র উঠে এসেছে, তা মোটেই স্বস্তিদায়ক নয়। পুষ্টিকর বা স্বাস্থ্যকর খাবার কেনার সংগতি নেই জনসংখ্যার ৭৩ শতাংশেরই।

প্রতিবেদন প্রণয়নকারী অপর চারটি সংস্থা হলো আন্তর্জাতিক কৃষি উন্নয়ন সংস্থা (ইফাদ), ইউনিসেফ, বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। এই প্রতিবেদনে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে পুষ্টিকর খাদ্যের জোগানে এগিয়ে আছে ভুটান ও শ্রীলঙ্কা। এরপর যথাক্রমে ভারত ও বাংলাদেশের অবস্থান। সবচেয়ে নাজুক অবস্থায় আছে নেপাল। পাকিস্তান বাংলাদেশের পেছনে।

স্বাধীনতার পর গত ৫১ বছরে বাংলাদেশে খাদ্য উৎপাদন বেড়েছে উল্লেখযোগ্যভাবে। কেবল ধান নয়, মাছ, সবজি, ফল, দুধ, ডিম, গবাদিপশু, হাঁস-মুরগি উৎপাদনেও আমাদের অগ্রগতি যথেষ্ট। তারপরও অধিকাংশ মানুষের নাগালে স্বাস্থ্যকর বা পুষ্টিকর খাবার না থাকার কারণ আয়বৈষম্য। দ্রুত ধনী হওয়া তালিকার শীর্ষে থাকা বাংলাদেশে দারিদ্র্য কমছে খুবই মন্থরগতিতে।

অন্যদিকে ধনী ও গরিবের বৈষম্য বাড়ছেই। উল্লিখিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে একজন মানুষের দৈনিক স্বাস্থ্যকর বা পুষ্টিকর খাবারের জন্য খরচ পড়ে প্রায় ২৭৬ টাকা। অথচ চার ভাগের তিন ভাগ মানুষেরই এ খাবার কেনার সামর্থ্য নেই।

২০১৪-১৬ সময়কালে তীব্র থেকে মাঝারি ধরনের খাদ্য অনিশ্চয়তায় ছিল ৫ কোটি ৪ লাখ মানুষ। তিন বছর পর ২০১৯-২১ সময়কালে একই ধরনের খাদ্য অনিশ্চয়তায় ছিল ৫ কোটি ২৩ লাখ মানুষ। অর্থাৎ দেশের মোট জনসংখ্যার ৩২ শতাংশ এ অনিশ্চয়তায় ছিল। এ হিসাবে ৬৮ শতাংশ মানুষের খাদ্য বিষয়ে অনিশ্চয়তা নেই। তবে তাদের উল্লেখযোগ্য অংশ স্বাস্থ্যকর খাবার খায় না বা খেতে পারে না। গড়ে একজন প্রাপ্তবয়স্ক সুস্থ, স্বাভাবিক মানুষের দিনে ২১০০ কিলোক্যালরির প্রয়োজন।

আমরা কোন দেশ থেকে এগিয়ে থাকলাম, আর কোন দেশ থেকে পিছিয়ে থাকলাম, তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো বাংলাদেশের শত ভাগ মানুষ পুষ্টিকর খাবার পাচ্ছে কি না। এর সরল উত্তর হলো, না। কোনো দেশের খাদ্য স্বনির্ভরতা প্রমাণ করে না যে সেই দেশের সব মানুষ স্বাস্থ্যকর খাদ্য পাচ্ছে। সুষম খাদ্য দূরে থাক, বাংলাদেশ এখনো প্রত্যেক নাগরিকের খাদ্যনিরাপত্তাই নিশ্চিত করতে পারেনি। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় সরকার অতি দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য খাদ্যসহায়তা দিচ্ছে; যা প্রয়োজনের তুলনায় কম। আবার খাদ্যসহায়তা মানে কেবল চাল নয়, পুষ্টিকর অন্যান্য খাবারও দেওয়া জরুরি।

শিশুদের পুষ্টি সমস্যা সমাধানে বিদ্যালয় পর্যায়ে দুপুরের খাবার দেওয়া হচ্ছে। এটা খুবই ভালো উদ্যোগ। একই সঙ্গে নারীদের জন্যও আলাদা খাদ্যসহায়তা কর্মসূচি নেওয়া প্রয়োজন। নারীদের পুষ্টি পরিস্থিতিবিষয়ক অপর এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৯ সালে নারীদের ৩৭ শতাংশ পুষ্টি সমস্যায় ভুগছিল। গত দুই বছরে পরিস্থিতির ইতরবিশেষ ঘটেছে বলে মনে হয় না।

তবে খাদ্যসহায়তাও স্থায়ী সমাধান নয়। প্রত্যেক নাগরিক যাতে প্রয়োজনীয় পুষ্টিকর খাবার খেতে পারে, সে জন্য তার সামর্থ্য তৈরি করতে হবে। এখনো দেশের শ্রমজীবী মানুষের বৃহত্তর অংশ যে আয় করে, তা দিনে পুষ্টিকর খাবারের জন্য যে ২৮৬ টাকা প্রয়োজন, তার চেয়ে কম। আমরা যদি সত্যিই একটি স্বাস্থ্যবান জাতি গড়ে তুলতে চাই, নাগরিকের আয় যেমন বাড়াতে হবে, তেমনি কমাতে হবে সামাজিক বৈষম্যও।