দূষণ-দুর্ঘটনাকেই উৎসাহিত করবে

সম্পাদকীয়

গত ১৭ মে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ প্রজ্ঞাপন জারি করেছিল যে ২০ বছরের পুরোনো বাস ও ২৫ বছরের পুরোনো ট্রাক সড়কে নামতে পারবে না। এর কারণ হিসেবে বলা হয়েছিল, পুরোনো যানবাহনের কারণে যেমন সড়ক দুর্ঘটনা হয়, তেমনি পরিবেশদূষণ বাড়ে।

মেয়াদোত্তীর্ণ লক্কড়ঝক্কড় মার্কা যানবাহন সড়কে চলাচল নিয়ে আপত্তি জানিয়ে আসছিলেন পরিবেশবিদসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। ৭ মের সিদ্ধান্তে তাঁরা কিছুটা আশ্বস্ত হয়েছিলেন।

কিন্তু তাঁদের সেই আশ্বস্ত হওয়া আর দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। ৭ আগস্ট প্রথম আলোর খবরে বলা হয়, পরিবহনমালিক-শ্রমিকদের চাপের মুখে পুরোনো লক্কড়ঝক্কড় যানবাহন উঠিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত থেকে পিছু হটেছে সরকার। ফলে ২০ বছরের পুরোনো বাস এবং ২৫ বছরের পুরোনো ট্রাক অবাধে চলতে পারবে সড়কে।

সরকার যখন এ সিদ্ধান্ত নিল, তখন ঢাকা শহরের বাতাসের মান খুবই অস্বাস্থ্যকর। বৃহস্পতিবার এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স (একিউআই) অনুযায়ী, বিশ্বের দূষিত শহরের তালিকায় ঢাকা আবারও প্রথম স্থানে এসেছে।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি ও ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান পরিচালনায় যুক্ত একাধিক মালিক সমিতি পুরোনো যানবাহন উঠিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। তাদের সংঘবদ্ধ অবস্থানের কারণে সরকার পিছু হটতে বাধ্য হয় এবং মন্ত্রণালয় আগের প্রজ্ঞাপন স্থগিত করে। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) সূত্র বলছে, ২০ বছরের সীমা নির্ধারণ করা হলে ৩৩ হাজার ১৭৪টি বাস-মিনিবাস রাস্তা থেকে উঠে যাবে। আর ২৫ বছরের পুরোনো ট্রাকের সংখ্যা ৩০ হাজার ৬২৩।

সারা দেশে বর্তমানে নিবন্ধিত যানবাহনের সংখ্যা ৫৮ লাখের কাছাকাছি। এর মধ্যে বাস-মিনিবাসের সংখ্যা ৮১ হাজার ৮৪৭। হিসাব করে দেখা যায়, বাস-মিনিবাসের প্রায় ৪১ শতাংশই ২০ বছরের পুরোনো। অন্যদিকে ২৫ বছরের পুরোনো ট্রাক আছে ১৫ শতাংশের মতো। সরকারের পিছু হটার পেছনে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বিষয়টিও কাজ করেছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে। সরকারের নীতিনির্ধারকেরা পরিবহনমালিক ও শ্রমিকদের মতো সংগঠিত শক্তিকে রুষ্ট করতে চায় না।

এর আগে নছিমন, করিমন, ভটভটির মতো যানবাহন গুরুত্বপূর্ণ সড়কে চলতে না দেওয়ার বিষয়ে জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিলের সিদ্ধান্তও কার্যকর হয়নি সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির বিরোধিতার কারণে। গত ৩০ জুলাই কমিটির বৈঠকে বলা হয়, ধীরগতির যানের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করলে আগামী নির্বাচনে প্রভাব পড়বে।

এ ক্ষেত্রে জনগণের নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্যের দিকটি আমলে না নেওয়া অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। স্বার্থান্বেষী মহলের চাপে সরকার একের পর এক ভালো সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসায় জনগণই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। পুরোনো যানবাহন চলাচলে কেবল জনস্বাস্থ্যই হুমকির মুখে পড়ছে না, দুর্ঘটনার মাত্রাও বেড়ে যাচ্ছে। পৃথিবীর দ্বিতীয় কোনো রাজধানী শহরে এ রকম লক্কড়ঝক্কড় মার্কা যানবাহন চলে বলে আমাদের জানা নেই।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক আবদুস সালাম প্রথম আলোকে বলেন, বায়ুদূষণের ক্ষেত্রে পুরোনো যানবাহনের দায় অনেক বেশি। সেগুলো উঠিয়ে দিতে হবেই।

কিন্তু সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে মানুষের কথা ভাবা হয় না। সিদ্ধান্তগুলো যাঁরা নেন, তাঁরা নিজেরাও বায়ুদূষণের ভুক্তভোগী, তাঁদের বয়স্ক মা-বাবা ভুক্তভোগী, তাঁদের শিশুসন্তানেরা ভুক্তভোগী।

সে ক্ষেত্রে সরকারের উচিত হবে স্বার্থান্বেষী মহলের চাপের কাছে নতি স্বীকার না করে ১৭ মের সিদ্ধান্তে অটল থাকা। পুরোনো যানবাহন তুলে নিলে জনগণ বায়ুদূষণের ভয়াবহতা থেকে রক্ষা পাবে।