স্বাস্থ্যসেবায় সমন্বিত পদক্ষেপ প্রয়োজন

সম্পাদকীয়

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) বিগত পাঁচ বছরের হিসাবে শিশুমৃত্যুর হার বেড়ে যাওয়া এবং গড় আয়ু কমে যাওয়ার যে চিত্র উঠে এসেছে, তা হতাশাজনক। দুই ক্ষেত্রেই আমাদের ক্রমাবনতি সার্বিক স্বাস্থ্যসেবার বেহালের কথাই মনে করিয়ে দেয়।

বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের হিসাবে দেশে মানুষের গড় আয়ু দাঁড়িয়েছে ৭২ দশমিক ৩ বছর। আগের বছর ছিল ৭২ দশমিক ৪। অন্যদিকে ২০২২ সালে দেশে এক বছরের কম বয়সী শিশুর মৃত্যুহার ছিল হাজারে ২৫ জন, যা ২০২৩ সালে বেড়ে হয়েছে ২৭। পাঁচ বছর আগে এই সংখ্যা ছিল ২১। দেশে পুরুষের গড় আয়ু দাঁড়িয়েছে ৭০ দশমিক ৮ বছর। অন্যদিকে নারীর গড় আয়ু হয়েছে ৭৩ দশমিক ৮ বছর।

বিবিএস প্রতিবছর ‘ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস’ প্রকাশ করে থাকে। এ পরিসংখ্যানের মাধ্যমে দেশের মানুষের জন্ম, মৃত্যু, আয়ুষ্কাল, বিয়ের মতো নানা বিষয়ের চিত্র উঠে আসে। প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৩ সালের ১ জুলাই দেশের প্রাক্কলিত জনসংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৭ কোটি ২৯ লাখ ২০ হাজারে।

স্বাধীনতার ৫৩ বছরে আর্থসামাজিক ও মানবসম্পদ উন্নয়নে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য সাফল্য আছে, এ কথা অস্বীকার করার জো নেই। বর্তমান সরকারের আমলে স্বাস্থ্যসেবা প্রত্যন্ত অঞ্চলে পৌঁছানো হয়েছে বলেও নীতিনির্ধারকেরা ফলাও প্রচার করে থাকেন। আবার অনেক ক্ষেত্রে আমরা সফল হতে পারিনি, সেটাও সত্য। তবে যেখানে যেটুকু অর্জন করা গেছে, সেখান থেকে পিছিয়ে যাওয়া স্বাভাবিক ঘটনা নয়। এখানে দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা ও ব্যক্তিদের কোনো গাফিলতি আছে কি না, সেটা খতিয়ে দেখা জরুরি বলে মনে করি।

বিবিএসের স্যাম্পল ভাইটাল রেজিস্ট্রেশন সিস্টেম (এসভিআরএস) ইন ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম প্রকল্পের পরিচালক আলমগীর হোসেন গড় আয়ু কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে শিশুমৃত্যুর হার ও অসংক্রামক ব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা বেড়ে যাওয়ার কথা বলেছেন। প্রশ্ন হলো এসব রোগ প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে কি না। যদি নেওয়া হয়, সেটা ফলপ্রসূ হলো না কেন। গড় আয়ু বেড়ে যাওয়ায় আমরা যতটা উল্লাস প্রকাশ করেছি, ধরে রাখার চেষ্টা সেভাবে করিনি। এই ধারা বজায় থাকলে গড় আয়ু আরও কমে যাওয়ার আশঙ্কা আছে।

শিশুমৃত্যু বেড়ে যাওয়ার ক্ষেত্রেও এই কথা প্রযোজ্য। প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা, গর্ভকালীন সেবা, প্রসবকালীন সেবা ও প্রসবোত্তর সেবা কার্যক্রমের ঘাটতিগুলো দূর করার চেষ্টা নেই বলেই অর্জন ধরে রাখা যাচ্ছে না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আটবার প্রসব-পূর্ব সেবা নেওয়ার সুপারিশ করেছে। কিন্তু বাংলাদেশে ৬০ শতাংশ গর্ভবতী চারবারও প্রসব-পূর্ব সেবা পান না। এই তথ্য সরকারের সফল স্বাস্থ্যসেবার উদাহরণ নয়।

মাতৃমৃত্যুর হার কমে যাওয়া যেমন স্বস্তির কারণ, তেমনি বাল্যবিবাহের হার বেড়ে যাওয়া বাড়তি উদ্বেগ তৈরি করে। ১৫ বছরের কম বয়সী মেয়েদের মধ্যে বিয়ের হার ৮ দশমিক ২ শতাংশ। ২০২২ সালে এই হার ছিল সাড়ে ৬ শতাংশ। ১৮ বছরের আগেই বিয়ে হয়ে যায় ৪১ দশমিক ৬ শতাংশ নারীর। ২০২২ সালে এই হার ছিল ৪০ দশমিক ৯ শতাংশ। এর আগে বলা হয়েছিল করোনাকালে বাল্যবিবাহ বেড়েছে। কিন্তু বিবিএসের পরিসখ্যান অনুযায়ী করোনার পর এই সামাজিক ব্যাধিটি আরও প্রকট হয়েছে। বাল্যবিবাহ রোধে আইন যত কড়াই হোক না কেন, এর প্রয়োগে মারাত্মক শৈথিল্য আছে।

শিশু থেকে বৃদ্ধ—সব বয়সের মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করাই হতে পারে শিশুমৃত্যুর হার কমানো এবং গড় আয়ু বাড়ানোর উপায়।