গরিব ঋণগ্রহীতাদের ওপর এই জুলুম কেন

সম্পাদকীয়

অবশেষে পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার ছলিমপুর ইউনিয়নের গ্রেপ্তার হওয়া ১২ কৃষক এবং গ্রেপ্তারের ভয়ে পলাতক ২৫ কৃষক জামিন পেয়েছেন। যে দেশে হাজার হাজার কোটি টাকা খেলাপি ঋণ নিয়েও রাঘববোয়ালেরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছেন, সেখানে গরিব ঋণগ্রহীতাদের ওপর এই জুলুম কেন?

প্রথম আলোর খবর থেকে জানা যায়, ভাড়ইমারি উত্তরপাড়া সবজি চাষি সমিতির সদস্য ওই ৩৭ কৃষক সমবায় ব্যাংক থেকে ১০ থেকে ৪০ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছিলেন ২০১৬ সালে। মোট ঋণের পরিমাণ ছিল ১৬ লাখ টাকা, যার মধ্যে ১৩ লাখ তাঁরা পরিশোধও করেছেন।

সমবায় ব্যাংকের মামলার পরিপ্রেক্ষিতে গত বুধবার পাবনার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ১২ জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। বাকিরা ভয়ে বাড়িছাড়া হয়েছিলেন। প্রথম আলোয় কৃষকদের ওপর এ হয়রানির খবর প্রকাশিত হওয়ার পর স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা তাঁদের জামিনের চেষ্টা করেন এবং রোববার তাঁরা জামিনও পেয়ে যান।

ভাড়ইমারি সবজি সমিতির সভাপতি ও ছলিমপুর ইউনিয়ন পরিষদের সংরক্ষিত নারী সদস্য বিলকিস ঋণের বিষয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছেন। ব্যাংক থেকে স্বল্প সুদে ঋণ পাওয়া যাবে, এ আশ্বাসে তিনি সমিতির ৩৭ সদস্যের জন্য ১৬ লাখ টাকা ঋণ আনার ব্যবস্থা করেন। পরে জানানো হয়, ১৫ শতাংশ হারে সুদ দিতে হবে। এতে কৃষকেরা ক্ষুব্ধ হন এবং বেশি সুদের কারণে অনেকে ঋণ শোধ করতে ব্যর্থ হন। সমিতির সদস্যরা ১৩ লাখ টাকা পরিশোধ করার পরও ব্যাংক আরও ১২ লাখ টাকা দাবি করে।

ব্যাংক তার পাওনা অর্থ আদায়ে আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারে। ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে মামলাও হতে পারে। কিন্তু তাই বলে খেলাপি হলেই কারাগারে পাঠাতে হবে, এটা কেমন কথা। যেখানে বড় বড় ঋণখেলাপি হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট করেও বহাল তবিয়তে আছেন, সেখানে কয়েক হাজার টাকার জন্য ১২ কৃষককে গ্রেপ্তার করার ঘটনা যেমন অস্বাভাবিক, তেমনি অনাকাঙ্ক্ষিত। আইন তো বড় খেলাপিদের জন্য এক রকম আর ছোট খেলাপিদের জন্য অন্য রকম হতে পারে না।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ সমবায় ব্যাংকের পাবনা শাখার ব্যবস্থাপক কাজী জসীম উদ্দীন ‘সেখানে নতুন এসেছেন এবং তাঁর আসার আগে মামলা হয়েছে’ বলে যে দায় এড়ানোর চেষ্টা করেছেন, তা একেবারে অগ্রহণযোগ্য। দরিদ্র কৃষকদের প্রতি ব্যাংকের এ আচরণ নির্মম বললেও কম বলা হয়। খেলাপি ঋণ আদায়ের জন্য ঋণগ্রহীতাদের গ্রেপ্তার করতে হলে, ওপর থেকেই শুরু করা উচিত; যাঁরা হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে গায়েব করে দিয়েছেন।

সাংবাদিক শওকত হোসেন ২৭ নভেম্বর প্রথম আলোয় ‘পারলে একজন বড় ঋণখেলাপিকে জেলে নিয়ে দেখান’ শিরোনামে উপসম্পাদকীয়ও লিখেছেন। আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে সরকারের দ্বিমুখী নীতির সমালোচনাও করেছেন তিনি।

এখানে সুদের হারের বিষয়টিও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ঋণগ্রহীতাদের কম সুদে ঋণ দেওয়ার কথা বলে যদি ব্যাংক বেশি সুদ দাবি করে থাকে, তাহলে সেটি ওয়াদাভঙ্গের নামান্তর। কাজটি ব্যাংকের ভেতরের বা বাইরের যিনিই করে থাকুন না কেন, তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।

ঋণগ্রস্ত কৃষকদের জামিনের ব্যবস্থা করে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিয়েছেন। গ্রুপ ঋণের ক্ষেত্রে একজনের হিস্যা অপরিশোধিত থাকলেও অন্যদের সেই দায় নিতে হয়। সে ক্ষেত্রে গরিব কৃষকদের বিষয়টি ব্যাংক কর্তৃপক্ষের উচিত সহৃদয়তার সঙ্গে দেখা।