এরপরও জরুরি পদক্ষেপ কেন নয়

সম্পাদকীয়

হর্ন না বাজিয়ে গাড়ি চালানো যায়; সে ধারণা বাংলাদেশে যাঁরা গাড়ি চালান, তাঁদের মধ্যে অনুপস্থিত। বরং সড়ক-মহাসড়ক থেকে শুরু করে অলিগলিতে কে কত জোরে ও কত বেশিবার হর্ন বাজাতে পারেন, সেই প্রতিযোগিতায় তাঁরা নামেন। ফলাফল হলো জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচির জরিপে ঢাকা বিশ্বের সবচেয়ে বেশি শব্দদূষণের শহর।

এ অভিশাপ থেকে অন্য শহরগুলোর নাগরিকেরাও মুক্ত নন। শব্দদূষণের ক্ষতিকর দিক নিয়ে নানা সময়ে গবেষণায় উদ্বেগজনক তথ্য উঠে এসেছে, জনস্বাস্থ্যবিদেরাও এর বহুমুখী ক্ষতির বিষয়ে সতর্ক করেছেন। কিন্তু শব্দদূষণ বন্ধে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কিংবা চালকেরা তাতে বিন্দুমাত্র কর্ণপাত করার প্রয়োজনীয়তা বোধ করেন না।

সম্প্রতি বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব হেলথ সায়েন্সেসের গবেষণায় উচ্চ মাত্রার শব্দদূষণের নেতিবাচক প্রভাবের যে চিত্র উঠে এসেছে, তা এককথায় ভয়াবহ। গবেষণায় উঠে এসেছে, সড়কে কর্মরত ব্যক্তিদের ২৫ শতাংশ কানে কম শোনেন।

আর ৭ শতাংশ মানুষ এতটাই কম শোনেন যে তাঁদের শ্রবণসহায়ক যন্ত্র ব্যবহার করতে হয়। ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ, রাজশাহী, কুমিল্লা ও সিলেট সিটি করপোরেশন এলাকার সড়কে কর্মরত পেশাজীবীদের নিয়ে এ গবেষণা পরিচালিত হয়। তাঁদের গড় বয়স ৩৮ বছর এবং সপ্তাহে ছয় দিন গড়ে ১১ ঘণ্টা সড়কে থাকতে হয়।

শব্দের অনুমোদিত মাত্রা যেখানে ৬০ ডেসিবেল, সেখানে সিটি করপোরেশন এলাকার সড়কে শব্দের মাত্রা পাওয়া গেছে ৮৪ থেকে ৯৯ ডেসিবেল পর্যন্ত। রিকশাচালকদের মধ্যে ৪২ শতাংশ এবং ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের মধ্যে প্রায় ৩১ শতাংশ কানের সমস্যায় ভুগছেন। এ ছাড়া বাস, অটোরিকশা, মোটরসাইকেলসহ অন্যান্য যানবাহনের চালক এবং সড়কের আশপাশের পেশাজীবীদের মধ্যে কানের সমস্যা শঙ্কাজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে।

উচ্চ মাত্রার শব্দদূষণ মানুষের জীবনীশক্তি ধীরে ধীরে ক্ষয় করে। শুধু কানে কম শোনা বা এ-জাতীয় সমস্যা নয়, শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের ওপরও এটি চূড়ান্ত রকম নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। জার্মান এক গবেষকের গবেষণায় উঠে এসেছে, শব্দদূষণ ঢাকা শহরের মানুষের আচরণ পাল্টে দিচ্ছে। অল্পতেই মেজাজ হারানো বা খেপে যাওয়ার প্রবণতা তৈরি হয় শব্দদূষণ থেকে। শব্দদূষণ যে জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতি, সেটা নীতিনির্ধারকেরা গণ্য করেন না। বাংলাদেশে শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে যে বিধিমালা রয়েছে, সেখানে বিস্তারিত বলা আছে, কোনো এলাকায় দিনের কোন সময়ে কোন ধরনের শব্দের মাত্রা কেমন হবে। এসব নিয়ম না মানলে জেল–জরিমানারও বিধান আছে।

হেলথ সায়েন্সেসের গবেষণা প্রতিবেদনে শব্দদূষণের সমস্যা সমাধানে আটটি সুপারিশ করা হয়েছে। এর মধ্যে রাজপথে শব্দদূষণের উৎস চিহ্নিত করা এবং মাত্রা কমানোর জন্য পদক্ষেপ নেওয়া, রাজপথে কর্মজীবীদের কর্মঘণ্টা কমানো ও নিয়মিত শ্রবণশক্তি পরীক্ষা করা। আমরা আশা করি, এ সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করা হবে।

শব্দদূষণ নীরব ঘাতক। বাকি বিশ্ব যেখানে বিশেষ পরিস্থিতি ছাড়া কেউ হর্ন বাজায় না, সেখানে আমাদের দেশে যানবাহন নিয়ে কেউ রাস্তায় নামলেই হর্ন বাজানোকে জরুরি কাজ বলে মনে করেন। কারণে-অকারণে হর্ন বাজাতেই থাকেন। তা রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের গাড়ি হোক বা যাত্রীবাহী বাসই হোক—কোনো ব্যতিক্রম নেই।প্রথমত, শব্দদূষণের অভিশাপ থেকে মুক্তির জন্য নিজেদের মানসিকতা বদলে ফেলা প্রয়োজন সবার আগে।

যঁারা নিজে গাড়ি চালান, তাঁদের সচেতন হতে হবে। আর মালিকদের উচিত চালকদের হর্নের ব্যাপারে সতর্ক করে দেওয়া। দ্বিতীয়ত, শব্দদূষণ বন্ধে যে আইন আছে, তার প্রয়োগ করতে হবে। বাস্তবতা হলো পরিবেশ অধিদপ্তর, সিটি করপোরেশন ও ট্রাফিক পুলিশ চাইলেই শব্দদূষণ বন্ধ করতে পারে। কিন্তু গুরুতর এ সমস্যা নিয়ে কারও মধ্যেই কোনো বিকার নেই। নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে শব্দদূষণকে মারাত্মক জনস্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার সময় এসেছে।