জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে হওয়াই প্রত্যাশিত

সম্পাদকীয়

বাংলাদেশের সমাজ-রাজনীতিতে যে অচলায়তন জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসেছিল, ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে স্বৈরাচার শেখ হাসিনা সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে সেটি সরে গেছে। এ অভ্যুত্থানের সবচেয়ে বড় অর্জন হচ্ছে এর মধ্য দিয়ে একটা গণতান্ত্রিক, মানবিক ও বহুত্ববাদী দেশ গড়ে তোলার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। হাজার প্রাণের বিনিময়ে গড়ে উঠেছে ঐক্য। দেশের ইতিহাসের অনন্য এই অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দিয়েছেন ছাত্ররা; সর্বস্তরের মানুষ ও রাজনৈতিক দল যুক্ত হয়ে সেটিকে সফল করে তোলে।

অভ্যুত্থানের প্রায় পাঁচ মাসের মাথায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে আজ ৩১ ডিসেম্বর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ‘জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র’ দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল। তাদের এই কর্মসূচি ঘিরে জনমনে কৌতূহল ও আগ্রহ তৈরি হয়। রাজনৈতিক দলগুলোর কারও কারও মধ্যে প্রশ্নও তৈরি হয়।

অন্তর্বর্তী সরকার আজকের কর্মসূচি নিয়ে প্রথমে বলেছিল যে এটা একটা বেসরকারি উদ্যোগ, এর সঙ্গে সরকারের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। যদিও সরকারে ছাত্ররা একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশীজন এবং জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র কর্মসূচির প্রতি তাঁদের কারও কারও সমর্থনের বিষয়টি স্পষ্ট।

তবে গতকাল রাতে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনার সামনে এক জরুরি প্রেস ব্রিফিংয়ে জানানো হয়, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষ থেকে জাতীয় ঐকমতে৵র ভিত্তিতে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের একটি ঘোষণাপত্র তৈরির উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা জনগণের ঐক্য, ফ্যাসিবাদবিরোধী চেতনা ও রাষ্ট্র সংস্কারের আকাঙ্ক্ষাকে সুসংহত রাখার জন্য এ ঘোষণাপত্র গৃহীত হবে।

৫ আগস্টের অভ্যুত্থানের তিন দিন পর ৮ আগস্ট অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে কয়েকজন উপদেষ্টা শপথ নেওয়ার মধ্য দিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের যাত্রা শুরু হয়। এরপর আরও কয়েক দফায় আরও কয়েকজন সরকারে যুক্ত হন। বিগত সরকারের আমলে অর্থনীতি ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো যেভাবে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে, সেখান থেকে অর্থনীতি ও দেশকে টেনে তুলে ঠিক পথে নিয়ে আসাটা নিঃসন্দেহে বড় একটা চ্যালেঞ্জ। এ পটভূমিতে অন্তর্বর্তী সরকার জন-আকাঙ্ক্ষার কথা মাথায় রেখে প্রথমে নির্বাচনব্যবস্থা, পুলিশ, বিচার বিভাগ, জনপ্রশাসন, সংবিধান ও দুর্নীতি দমন বিষয়ে সংস্কারের জন্য ছয়টি কমিশন গঠন করে। এরপর আরও কয়েকটি কমিশন গঠন করা হয়েছে।

প্রথমে গঠিত ছয়টি কমিশন তাদের সংস্কার প্রস্তাব প্রায় গুছিয়ে এনেছে। সাধারণ নাগরিক, রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজসহ অন্য অংশীজনরা কমিশনগুলোর কাছে তাঁদের প্রস্তাব দিয়েছেন। আশা করা হচ্ছে, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কমিশনগুলো অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে তাদের প্রতিবেদন জমা দেবে। সরকারপ্রধান এই ছয় কমিশনের প্রধানকে নিয়ে একটি ঐকমত্য কমিশন গঠনের ঘোষণাও দিয়েছেন। রাজনৈতিক দল ও অন্য অংশীজনদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা ও সংলাপের মাধ্যমে একটা জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করাই এর মূল উদ্দেশ্য।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান বাংলাদেশের সব শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্যে বড় একটি জন-আকাঙ্ক্ষা তৈরি করেছে। মানুষ আর পুরোনো ব্যবস্থায় ফিরে যেতে চায় না, তারা চায় পরিবর্তন। জন-আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তব রূপ দিতে গেলে সংস্কার ও নির্বাচন প্রশ্নে একটা জাতীয় ঐকমত্য অর্জনের বিকল্প নেই।

বিজয় দিবসের ভাষণে এবং ফোরাম ফর বাংলাদেশ স্টাডিজের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস নির্বাচন কবে হবে, তা নিয়ে একটা ধারণা দিয়েছেন। আমরা মনে করি, যে মহত্তর আকাঙ্ক্ষা নিয়ে গণ-অভ্যুত্থান হয়েছে, সেখানে অভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া সব পক্ষের ঐক্য ও সংহতি বজায় রাখাটা এই সময়ে সবচেয়ে জরুরি।

প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইংয়ের ব্রিফিংয়ের পর রাতেই জরুরি বৈঠকে বসেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির নেতারা। বৈঠক শেষে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষ থেকে জাতীয় ঐকমতে৵র ভিত্তিতে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র তৈরির উদ্যোগকে সাধুবাদ জানান তাঁরা। পরে আজ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ‘মার্চ ফর ইউনিটি’ কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়।

জুলাই অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের সমাজ ও রাজনীতিতে যে গণতান্ত্রিক আবহ তৈরি হয়েছে, সেখানে গণতান্ত্রিকভাবে যে কেউই তাঁদের কর্মসূচি পালন করবেন, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু মানবিক ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ে তোলার প্রশ্নে যে সামষ্টিক আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে, সেখানে যেন কোনো বড় বিভক্তি, বিভাজন তৈরি না হয়, সেদিকে সবারই সচেতন থাকা জরুরি কর্তব্য। আলাপ-আলোচনা ও সংলাপের ভিত্তিতে একটা জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করে এগিয়ে যাওয়াটাই এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য পথ। মার্চ ফর ইউনিটি কর্মসূচি শান্তিপূর্ণভাবে পালিত হোক, সেটাই প্রত্যাশিত।