প্রতারণাটি ফৌজদারি অপরাধ

সম্পাদকীয়

সাবেক পুলিশপ্রধান বেনজীর আহমেদের সারা দেশে যে সম্পদের হিসাব পাওয়া যাচ্ছে, তাকে আলাদিনের চেরাগ বললেও কম বলা হবে। একজন বেতনভোগী সরকারি কর্মকর্তা হয়ে তিনি কী করে শত শত কোটি টাকার সম্পদের মালিক হলেন, সে বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তদন্ত শুরু করেছে। দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বেনজীর আহমেদ ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের স্থাবর–অস্থাবর সম্পদ জব্দ করারও নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।

কিন্তু আদালতের নির্দেশের আগেই সাবেক পুলিশপ্রধান সপরিবার দেশ ছেড়েছেন বলে সংবাদমাধ্যমে খবর এসেছে; যদিও এ বিষয়ে সরকারের কোনো সূত্র কিছু জানায়নি। এই প্রেক্ষাপটে বেনজীর আহমেদের পাসপোর্ট জালিয়াতির অবিশ্বাস্য তথ্য পাওয়া গেছে। অনুসন্ধানে জানা যায়, বেনজীর তাঁর পুরোনো হাতে লেখা পাসপোর্ট নবায়নের আবেদন করেন ২০১০ সালের ১১ অক্টোবর। তিনি নীল রঙের অফিশিয়াল পাসপোর্ট না নিয়ে সাধারণ পাসপোর্ট নেন এবং পরিচয় লেখেন ‘প্রাইভেট সার্ভিস’। এরপর ২০১৪ সালে ঢাকার পুলিশ কমিশনার ও ২০১৬ সালে র‍্যাবের মহাপরিচালক থাকাকালে ক্ষমতার অপব্যবহার করে দুবার পাসপোর্ট নবায়নও করেন একই পরিচয়ে।

২০১৬ সালে পাসপোর্ট অধিদপ্তর থেকে বেনজীরের পাসপোর্ট আটকে দিলে র‌্যাব সদর দপ্তরের তৎকালীন অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অবিলম্বে তাঁর পাসপোর্ট প্রতিস্থাপনের অনুরোধ করে চিঠি দেন। এর ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বেনজীরকে পাসপোর্ট দিতে বাধ্য হয় পাসপোর্ট অধিদপ্তর (ডিআইপি)। পাসপোর্ট নবায়নের সময়ে আবেদনকারীকে নিজে দপ্তরে হাজির হয়ে ছবি তুলতে ও আঙুলের ছাপ দেওয়ার বিধান থাকলেও তিনি তা মানেননি। গুরুতর অসুস্থতার অজুহাত দেখিয়ে বেনজীর ডিআইপির কাছে মোবাইল ইউনিট চেয়ে পাঠান এবং দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা তাঁর বাসায় গিয়ে সব আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করেন।

বেনজীর আহমেদ যে পদে আসীন ছিলেন, তাতে তাঁর লাল পাসপোর্ট পাওয়ার কথা। বোধগম্য কারণেই তিনি সেটি নেননি। সরকারি চাকরিজীবীর পরিচয়ে পাসপোর্ট নিলে বিদেশে যেতে সরকারের অনুমতি নিতে হয়। বেসরকারি চাকরিজীবী হলে তা নেওয়ার প্রয়োজন হয় না। তিনি অসত্য পরিচয় দিয়ে পাসপোর্ট নিয়ে ফৌজদারি অপরাধ করেছেন। তবে এই পাসপোর্ট করার পেছনে নির্বিঘ্নে বিদেশ সফরই বেনজীরের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল না।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বেনজীরের পাসপোর্টের ঘটনাটিকে ন্যক্কারজনক প্রতারণা ও জালিয়াতি বলে অভিহিত করেছেন। এর আগে সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদও তাঁর ভাইয়ের ভুয়া পরিচয়পত্র (আইডি) দেওয়ার সুপারিশ করেছিলেন বলে নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা গেছে। প্রথম আলোয় এ নিয়ে একাধিক প্রতিবেদনও প্রকাশিত হয়েছে।

দুদকের তদন্তের শুরুতে বেনজীরের দেশত্যাগের খবর নিয়ে জনমনে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। কারা তাঁকে বিদেশ যেতে সহায়তা করেছেন, সে প্রশ্নও আসবে। একজন মন্ত্রী বলেছেন, বেনজীরের বিদেশ যাওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা না থাকায় তিনি যেকোনো দেশে যেতে পারেন। কিন্তু যে ব্যক্তির সম্পদ আদালত জব্দ করেছেন এবং দুদক যাঁকে ৬ জুন তাদের দপ্তরে হাজির হতে বলেছে জবানবন্দি নেওয়ার জন্য, তাঁর সম্পর্কে এ ধরনের মন্তব্য কী ইঙ্গিত দেয়?

বেনজীর কী পরিমাণ অবৈধ সম্পদ করেছেন, আশা করি তদন্তে তা বেরিয়ে আসবে। কিন্তু তিনি যে ক্ষমতার অপব্যবহার করে বেসরকারি চাকরিজীবীর পাসপোর্ট নিয়েছেন, সেটা তো প্রমাণিত। যিনি সরকারি চাকরিতে থাকা অবস্থায় বেসরকারি সার্ভিস দেখিয়ে পাসপোর্ট নিয়েছেন এবং তাঁর এই অবৈধ কাজে যাঁরা সহায়তা করেছেন, তাঁদের সবার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হোক।