এই অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি কি এড়ানো যেত না

সম্পাদকীয়

১৬ জুলাই (বুধবার) জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সমাবেশ ঘিরে গোপালগঞ্জে যে সহিংসতা ও প্রাণহানি ঘটেছে, তা অনাকাঙ্ক্ষিত ও নিন্দনীয়।

প্রত্যক্ষদর্শীর বরাত দিয়ে সংবাদমাধ্যমগুলো জানাচ্ছে, এনসিপির সমাবেশের আগেই আওয়ামী লীগ ও নিষিদ্ধঘোষিত ছাত্রলীগের কর্মী-সমর্থকেরা রাস্তায় গাছ কেটে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে, পুলিশের গাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও ইউএনওর গাড়ি ভাঙচুর করে। একপর্যায়ে সমাবেশস্থলে ভাঙচুর চালায়। বিকেলে সমাবেশ শেষ করে যখন এনসিপির নেতারা গাড়িতে করে পুলিশি পাহারায় মাদারীপুরের দিকে যাচ্ছিলেন, তখন আবার তাঁদের ওপর হামলা চালানো হয়। এ সময় পুলিশ ও সেনাসদস্যদের সঙ্গে হামলাকারীদের সংঘর্ষ বাধে। এ ঘটনায় যে চারজন নিহত হয়েছেন, তঁাদের সবার শরীরে গুলির চিহ্ন পাওয়া যায়। যাঁরা আহত হয়েছেন, তঁাদের কয়েকজনও গুলিবিদ্ধ হয়েছেন।

প্রশ্ন উঠেছে, গোপালগঞ্জে এনসিপির সমাবেশ ঘিরে যে সহিংসতা ও প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে, তা এড়ানো যেত কি না? এ ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও স্থানীয় প্রশাসনের কোনো ব্যর্থতা ছিল কি না?

এনসিপির সমাবেশের আগে থেকে গোপালগঞ্জে উত্তেজনা বিরাজ করছিল, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানা রকম উসকানি দেওয়া হয়েছিল আওয়ামী লীগ এবং এর সহযোগী সংগঠনের নামে। আবার এনসিপির কোনো কোনো নেতার দিক থেকে এমন কিছু পোস্ট দেওয়া হয়, যেটা পরিস্থিতিকে উত্তপ্ত করে তোলে। এ ক্ষেত্রে স্থানীয় সংবেদনশীলতার বিষয়টি এনসিপির নেতারা মনে রেখেছিলেন কি না, সেটাও বড় একটা প্রশ্ন। ১ জুলাই থেকে সারা দেশে তাদের কর্মসূচি ছিল ‘জুলাই পদযাত্রা’। গোপালগঞ্জের ক্ষেত্রে  সেটি ‘মার্চ টু গোপালগঞ্জ’ হলো কেন? দুই কর্মসূচির অর্থ এক নয়।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে যদি প্রতীয়মান হয়ে থাকে, সমাবেশ ঘিরে বড় ধরনের বিশৃঙ্খলা হতে পারে, তাদের উচিত ছিল সে রকম প্রস্তুতি নেওয়া। গোয়েন্দা সংস্থাগুলো আগে থেকে সতর্ক করে দিয়েছিল বলেও সংবাদমাধ্যমে খবর এসেছে। এরপরও স্থানীয় প্রশাসন প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিল না কেন? এনসিপির এক নেতা বলেছেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে জিজ্ঞাসা করা হলে তাঁকে জানানো হয়েছিল, ‘কোনো সমস্যা নেই।’ সমস্যা যে ছিল, তা স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলমের কথায়ই উঠে এসেছে। তিনি বলেছেন, ‘গোয়েন্দাদের কাছে তথ্য ছিল, তবে এত পরিমাণ (সহিংসতা) হবে, সেটা ছিল না।’ এই ব্যর্থতা কি সরকারের নয়?

এনসিপির সমাবেশে হামলার ঘটনায় নিন্দা করেছে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন, গণ অধিকার পরিষদসহ অনেক দল। একই সঙ্গে তারা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে কর্মসূচি নেওয়ার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টদের প্রতি সতর্ক থাকারও আহ্বান জানানো হয়েছে।

সংবাদমাধ্যম থেকে জানা যায়, যে চারজন গুলিতে মারা গেছেন, তাঁদের অন্তত তিনজন কোনো রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। গোপালগঞ্জে এনসিপির সমাবেশে হামলার ঘটনায় ইতিমধ্যে ১৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এসব হামলার সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের সবাইকে অবশ্যই বিচারের আওতায় আনতে হবে। কিন্তু অপরাধী ধরার নামে যাতে নিরীহ মানুষ হয়রানির শিকার না হন, সে বিষয়েও সতর্ক থাকতে হবে।

আমরা এনসিপির রাজনৈতিক কর্মসূচিতে হামলা এবং সংঘর্ষে প্রাণহানির ঘটনায় তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি। সহিংসতা ও প্রাণহানির ঘটনা তদন্তে একটি কমিটি করেছে সরকার। আমরা আশা করি, সহিংসতা দমনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কর্তৃক অতিরিক্ত বলপ্রয়োগের ঘটনা ঘটেছে কি না, সেটা সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্তে বের হয়ে আসবে।

এ মুহূর্তে সরকারের দায়িত্ব গোপালগঞ্জে স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনা। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সেখানকার এইচএসসি পরীক্ষা স্থগিত করায় শিক্ষার্থী ও অভিভাবকেরা উদ্বিগ্ন। গোপালগঞ্জে অস্বাভাবিক পরিস্থিতি প্রলম্বিত হলে এর নেতিবাচক প্রভাব দেশের অন্যত্র পড়াও অস্বাভাবিক নয়।