সরকারের অভিযান কতটা দৃশ্যমান

‘দেশে আসেন ভাই, গুলির হিসাব দিয়ে যান।’ এটা কোনো বাংলা চলচ্চিত্রের সংলাপ নয়। সৌদি আরব থেকে লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান এ কে এম সালাহউদ্দিনের পাঠানো ‘দোয়ার দরখাস্তের’ জবাবে একজন ফেসবুক ব্যবহারকারী বাক্যটি লিখেছেন। 

লক্ষ্মীপুরের প্রয়াত গডফাদার আবু তাহেরের পুত্র সালাহউদ্দিন ও তাঁর সহযোগীরা গত ৪ আগস্ট নিজের বাসার ছাদ থেকে আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি চালিয়ে চারজনকে হত্যা করেন। 

কেবল লক্ষ্মীপুর নয়, দেশের বিভিন্ন স্থানে আন্দোলনকারী ছাত্র–জনতার ওপর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের পাশাপাশি আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের একশ্রেণির নেতা-কর্মীকে গুলি করতে দেখা গেছে। 

৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সালাহউদ্দিনসহ অনেক অস্ত্রধারী বিদেশে পালিয়ে গেছেন। অনেকে দেশের ভেতরে আত্মগোপন করে আছেন। ১৩ অক্টোবর প্রথম আলোয় প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ঢাকাসহ দেশের ১২টি জেলায় আন্দোলনকারীদের ওপর গুলিবর্ষণকারী ১২৬ জন অস্ত্রধারীকে শনাক্ত করা গেছে, যার মধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছেন মাত্র ১৯ জন। আন্দোলন দমাতে প্রকাশ্যে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে ছাত্র-জনতার ওপর গুলি করার ঘটনা ঘটেছে রাজধানী ঢাকাসহ অন্তত ১২ জেলায়। অন্য জেলাগুলো হলো চট্টগ্রাম, ফেনী, নারায়ণগঞ্জ, ফরিদপুর, রংপুর, জামালপুর, হবিগঞ্জ, রাজশাহী, সিরাজগঞ্জ, সিলেট ও লক্ষ্মীপুর। 

আওয়ামী লীগের এই গুলিবর্ষণকারী নেতা-কর্মীদের মধ্যে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরাও ছিলেন। নারায়ণগঞ্জের সাবেক সংসদ সদস্য শামীম ওসমানকেও আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে গুলি করতে দেখা গেছে। তিনিও মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশে পালিয়ে গেছেন বলে জানা যায়। মোহাম্মদপুরে তিনটি গুলির ঘটনায় সাবেক দুই কাউন্সিলর ও সাবেক এক মন্ত্রীর সহযোগী জড়িত ছিলেন। অস্ত্রধারীদের একাংশের বিদেশে পালিয়ে যাওয়া এবং অপর অংশ দেশের ভেতরে থাকলেও তাঁদের ধরা না পড়া জননিরাপত্তার জন্য খুবই উদ্বেগজনক। 

গণ-অভ্যুত্থানের সময় বিভিন্ন স্থানে কিছু অস্ত্র লুট হয়েছে। অস্ত্রধারীদের গ্রেপ্তারের পাশাপাশি অস্ত্রগুলো উদ্ধার করা অত্যন্ত জরুরি। অস্ত্রধারীরা আত্মগোপনে থাকলেও তাঁদের অস্ত্র যে ‘আত্মগোপনে’ আছে, এর নিশ্চয়তা নেই। সম্প্রতি মোহাম্মদপুরে এক ব্যবসায়ীর বাড়িতে যে ডাকাতি হলো,
এতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বরখাস্ত চার কর্মকর্তা জড়িত বলে জানা গেছে। 

র‍্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মুনীম ফেরদৌস প্রথম আলোকে বলেন, ছাত্র-জনতার ওপর আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে হামলায় জড়িত ব্যক্তিদের চিহ্নিত করা হচ্ছে। এরই মধ্যে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে অন্তত ১৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। 

কিন্তু লক্ষ্মীপুরের সালাহউদ্দিনের মতো যাঁরা বিদেশে চলে গেছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে তো কোনো লাভ হবে না। আগেভাগে অভিযান চালালে তাঁদের ধরা যেত। অস্ত্রধারীদের মধ্যে কারা বিদেশে গেছেন, কারা দেশেই আছেন, সেটাও জানা দরকার। স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন উঠবে, সরকার যাঁদের শনাক্ত করেছে বলে দাবি করছে, দ্রুত তাঁদের ধরা হচ্ছে না কেন? 

আওয়ামী লীগের যেসব নেতা অস্ত্র জমা দেননি, তাঁদের বিরুদ্ধে কী আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তা-ও জনগণকে জানানো হোক। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আবদুল কাদের বলেছেন, পুলিশ এখনো পুরোপুরি সক্রিয় না হওয়ায় অস্ত্রধারীদের গ্রেপ্তার-কার্যক্রম ধীরগতিতে চলছে। ইতিমধ্যে দুই মাসের বেশি সময় পার হয়ে গেছে। পুলিশ কবে সক্রিয় হবে? পুলিশের পাশাপাশি র‍্যাব, বিজিবি ও সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরাও তো আইনশৃঙ্খলার দায়িত্বে আছেন। যৌথ অভিযান চালানো হচ্ছে। এ সময়ও যদি অস্ত্রধারীরা ধরা না পড়ে, তাহলে তাঁদের পাকড়াও করা কঠিন হবে।