ঢাকায় জনসংখ্যার বাড়তি চাপ নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে, নেতারা অনেক রাজনৈতিক বক্তৃতা দিয়েছেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো ঢাকার জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য কার্যকর কোনো পদক্ষেপ এখনো দৃশ্যমান নয়। এই প্রেক্ষাপটে গত শনিবার ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) আয়োজিত ‘ঢাকার বিকেন্দ্রীকরণ এবং বাংলাদেশের টেকসই নগরায়ণ’ শীর্ষক সেমিনারে যেসব তথ্য উঠে এসেছে, তা উদ্বেগজনক বললেও কম বলা হবে।

সেমিনারে উত্থাপিত মূল প্রবন্ধে বলা হয়, দেশের মোট আয়তনের ১ শতাংশ (১ হাজার ৫২৮ বর্গকিলোমিটার) ভূমি নিয়ে ঢাকা মহানগর এলাকা গঠিত। অথচ দেশের নগর জনসংখ্যার ৩২ শতাংশ ঢাকায় বাস করে।

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রতিবছর বাস্তুচ্যুত হয় প্রায় ৭ লাখ মানুষ, যাদের বেশির ভাগ আশ্রয় নেয় ঢাকা শহরে। ঢাকাকেন্দ্রিক নগরায়ণের কারণে যেমন যানজট, পানিদূষণ, বায়ুদূষণের মতো চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হচ্ছে, তেমনি মানুষের কর্মঘণ্টা নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি বাড়ছে জ্বালানি খরচ ও স্বাস্থ্যঝুঁকি।

সেমিনারে ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী ঢাকাকেন্দ্রিক উন্নয়ন কর্মসূচি থেকে বেরিয়ে আসার তাগিদ দিয়েছেন। এর আগেও অনেক মন্ত্রী ও গবেষক একই কথা বলেছেন। কিন্তু উন্নয়ন কর্মসূচি বিকেন্দ্রীকরণের কোনো উদ্যোগ লক্ষ করা যাচ্ছে না। সরকারি-বেসরকারি অফিস, শিল্পকারখানার পাশাপাশি শিক্ষা ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানও ঢাকা শহরে কেন্দ্রীভূত।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ও জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের (ইউএনএফপিএ) দেওয়া এক হিসাব অনুযায়ী ঢাকা পৃথিবীর সবচেয়ে জনবহুল শহরগুলোর তালিকায় ১১তম। কিন্তু আয়তনের তুলনায় জনসংখ্যার হিসাবে ঢাকা এখন পৃথিবীর সবচেয়ে জনঘন শহর। এখানে প্রতি বর্গকিলোমিটারে বাস করে ৪৩ হাজার ৫০০ মানুষ। দ্বিতীয় ঘনবসতিপূর্ণ শহরে মুম্বাইয়ে বাস করে ৩২ হাজার ৪০০ জন। ২০১৬ সালে প্রকাশিত প্রথম আলোর তথ্য অনুযায়ী ঢাকা শহরে প্রতিদিন ১ হাজার ৭০০ মানুষ যুক্ত হচ্ছে। গত কয়েক বছরে ঢাকামুখী জনস্রোত আরও বেড়েছে।

ঢাকা শহরে বাড়তি জনসংখ্যা যে একটি বড় সমস্যা, সরকারের উন্নয়ননীতি-পরিকল্পনায় তার ছাপ নেই। তারা ঢাকা শহরের যানজট কমাতে একের পর এক মেট্রোরেল ও দ্রুতগতির উড়ালসড়ক নির্মাণ করছে। কিন্তু দেড় কোটির বেশি মানুষের জন্য যে আবাসন, পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাস ইত্যাদি প্রয়োজন, তা নিশ্চিত করা যায়নি। এ কারণে ঢাকার অবস্থান বাসযোগ্য শহরের তালিকায় একবারে তলানিতে।

এ প্রেক্ষাপটে ‘গ্রামে শহরের সুবিধা পাওয়া যাবে’ স্লোগানই যথেষ্ট নয়; সরকারের উন্নয়ন–পরিকল্পনাগুলো এমনভাবে নিতে হবে, যাতে ঢাকামুখী প্রবণতা কমে যায়। ঢাকার মতো অন্যান্য বিভাগীয় শহর তো বটেই, গ্রামাঞ্চলেও কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে।

সরকারের সব প্রশাসনিক ও বাণিজ্যিক বিভাগের সদর দপ্তর ঢাকায় রাখার কোনো যুক্তি নেই। এরশাদ সরকারের আমলে বেশ কয়েকটি বিভাগ ও সংস্থার প্রধান কার্যালয়ে ঢাকার বাইরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।

কিন্তু পরবর্তীকালে রাজনৈতিক চাপে সেগুলো ঢাকায় স্থানান্তর করা হয়েছে, যা ছিল আত্মঘাতী। সরকার ডিজিটাল থেকে স্মার্ট বাংলাদেশ করার ঘোষণা দিয়েছে। স্মার্ট বাংলাদেশে সব কাজ ঢাকা থেকে হতে হবে কেন?

‘অবাসযোগ্য রাজধানী শহর’কে বাসযোগ্য করতে হলে ঢাকামুখী জনস্রোত কমাতেই হবে। নীতিনির্ধারকদের মনে রাখতে হবে, বিকেন্দ্রীকরণ করা ছাড়া ঢাকাকে বাঁচানো যাবে না।