যা বাতিল হওয়ার যোগ্য, তা স্থায়ী হবে কেন

সম্পাদকীয়

বিএনপি সরকারের আমলে আওয়ামী লীগ যে আইনের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিল, সেই আইনটিকে তারা স্থায়ী রূপ দিতে যাচ্ছে। গত সোমবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠকে আইনশৃঙ্খলা বিঘ্নকারী অপরাধ (দ্রুত বিচার) (সংশোধন)-২০২৪-এর খসড়ার চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়। বিএনপি আমলে (২০০১-২০০৬) আইনটির মেয়াদ বাড়ানো হয়েছিল। টানা ১৫ বছর ধরে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারও দফায় দফায় আইনটির মেয়াদ বাড়িয়েছে।

সোমবার মন্ত্রিসভার বৈঠকের পর মন্ত্রিপরিষদ সচিব মাহবুব হোসেন জানান, আইনশৃঙ্খলা বিঘ্নকারী অপরাধ (দ্রুত বিচার) আইন, ২০০২ জারি করার সময় এর মেয়াদ ছিল দুই বছর। পরবর্তী সময়ে মেয়াদ বাড়ানো হয়। সর্বশেষ মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা আগামী ৯ এপ্রিল। মন্ত্রিসভায় এটিকে স্থায়ীভাবে গ্রহণ করার নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়ায় নতুন করে মেয়াদ বাড়াতে হবে না।

আইনশৃঙ্খলা বিঘ্নকারী অপরাধ (দ্রুত বিচার) আইন, ২০০২ অনুযায়ী কোনো ব্যক্তি আইনশৃঙ্খলা বিঘ্নকারী কোনো অপরাধ করলে তিনি অন্তত দুই বছর এবং সর্বোচ্চ সাত বছর পর্যন্ত সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন এবং অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত হবেন। এ ছাড়া দণ্ডপ্রাপ্ত কোনো ব্যক্তি অপরাধ সংঘটনকালে সরকার বা সংবিধিবদ্ধ সংস্থা বা কোনো প্রতিষ্ঠান বা কোনো ব্যক্তির আর্থিক ক্ষতিসাধন করলে সে জন্য আদালত তা বিবেচনা করে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিতে ওই দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে আদেশ দিতে পারবেন এবং এই ক্ষতিপূরণের অর্থ সরকারি দাবি হিসেবে আদায়যোগ্য হবে।

বিচারপদ্ধতি সম্পর্কে বলা হয়েছে, আদালত এই আইনের অধীন সংঘটিত অপরাধের বিচার সংক্ষিপ্ত পদ্ধতিতে সম্পন্ন করবেন। ফৌজদারি কার্যবিধির অধ্যায় ২২-তে বর্ণিত পদ্ধতি, যত দূর প্রযোজ্য হয়, তা অনুসরণ করবেন।

দ্রুত বিচার আইন অনুযায়ী, অপরাধ সংঘটনের পরবর্তী সাত কার্যদিবসের মধ্যে ধারা ৯ (২)-এর অধীন রিপোর্ট বা অভিযোগ দাখিল করতে হবে। এই রিপোর্ট বা অভিযোগ দায়েরের পরবর্তী ৬০ কার্যদিবসের মধ্যে (ধারা ১১-এর বিধান সাপেক্ষে) আদালত বিচারকার্য সম্পন্ন করবেন। বিচারের ক্ষেত্রে একটি কথা প্রচলিত আছে—জাস্টিস ডিলেড, জাস্টিস ডিনাইয়েড। জাস্টিস হারিড, জাস্টিস বারিড। বিচার বিলম্বিত হলে যেমন বিচার না পাওয়ার আশঙ্কা থাকে, তেমনি বিচার দ্রুত হলেও অভিযুক্ত ব্যক্তি ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হন।

আইনমন্ত্রী আনিসুল হক আইনটি স্থায়ী করার পক্ষে যুক্তি দেখিয়ে বলেছেন, আইনটি আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় কার্যকর ভূমিকা রাখছে। সে ক্ষেত্রে প্রশ্ন উঠবে বিএনপি আমলে যখন আইনটি জারি করা হলো, তখন আওয়ামী লীগ স্বাগত না জানিয়ে কেন প্রতিবাদ করল? কেবল বিরোধী দল নয়, বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থাও এ আইনের কঠোর সমালোচনা করেছিল। যে আইনের উদ্দেশ্যই রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নাজেহাল করা, সে আইনে ন্যায়বিচার আশা করা যায় না।

২৮ অক্টোবরের পর বেশ কিছু মামলায় বিএনপির সহস্রাধিক নেতা-কর্মীকে এই আইনে শাস্তি দেওয়া হয়েছে, যার যথার্থতা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন আছে। এ আইনে গায়েবি মামলায়ও অনেকের শাস্তি হয়েছে বলে অভিযোগ আছে।

বিএনপি আমলে যে যুক্তিতে আওয়ামী লীগ দ্রুত বিচার আইনের বিরোধিতা করেছিল, সে যুক্তিতেই আইনটির অবসান হওয়া উচিত। আইনটি সর্বশেষ মেয়াদ শেষ হওয়ার পর এর মেয়াদ বাড়ানো কিংবা স্থায়ী রূপ দেওয়ার অর্থ হবে একটি অগণতান্ত্রিক আইনের দায় সরকারের কাঁধে নেওয়া। আওয়ামী লীগের দাবি অনুযায়ী যে আইন বাতিল হওয়ার কথা, সেই আইন কেন স্থায়ী রূপ পাবে? অতএব বিএনপি আমলে প্রণীত দ্রুত বিচার আইনটিকে যত দ্রুত সম্ভব বাতিল করা হোক।