বাইরের সদস্য রাখা বাধ্যতামূলক করতে হবে

সম্পাদকীয়

কর্মক্ষেত্রে ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নারীদের নিরাপত্তা এবং যৌন হয়রানির শিকার ভুক্তভোগী নারীদের বিচার নিশ্চিত করতে ২০০৯ সালে হাইকোর্ট একটি যুগান্তকারী রায় দিয়েছিলেন। যৌন হয়রানি প্রতিরোধে এ রায়ের অন্যতম ভিত্তি ছিল স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা। এই লক্ষ্যে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল যে অভিযোগ কমিটিতে অন্তত দুজন এমন সদস্যকে রাখতে হবে, যাঁরা প্রতিষ্ঠানের বাইরের এবং জেন্ডার ও যৌন নিপীড়ন প্রতিরোধে অভিজ্ঞ। কিন্তু আইনের চূড়ান্ত খসড়া তৈরির সময় দেখা গেল বাইরের সদস্য রাখার বাধ্যবাধকতা বাদ দেওয়া হয়েছে। এ নিয়ে অধিকারকর্মীরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।

প্রথম আলোর প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে, দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর যখন আইনের চূড়ান্ত খসড়া তৈরি হলো, তখন এই গুরুত্বপূর্ণ বাধ্যবাধকতাকে বাতিল করে ‘প্রাপ্যতা সাপেক্ষে’ বহিরাগত সদস্য রাখার বিষয়টি ঐচ্ছিক করে দেওয়া হয়েছে। এই সিদ্ধান্ত একটি মহৎ উদ্যোগের মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়ার শামিল। এটি কেবল আইনের কার্যকারিতাকে দুর্বল করবে না, বরং ভুক্তভোগী নারী ও শিশুর ন্যায়বিচার পাওয়ার পথকেও কঠিন করে তুলবে। জানা গেছে, মূলত পোশাকশিল্প কারখানার মালিকদের সংগঠনগুলোর আপত্তিতে এই বাধ্যবাধকতা রাখা হচ্ছে না।

বাইরের সদস্যদের বাধ্যতামূলক উপস্থিতি অভিযোগ নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে অপরিহার্য কিছু ভূমিকা পালন করে। অভ্যন্তরীণ অভিযোগ কমিটিতে যখন সম্পূর্ণ প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব লোক থাকে, তখন প্রতিষ্ঠানটির নিজস্ব ভাবমূর্তি বা স্বার্থ রক্ষার প্রবণতা দেখা যায়। ফলে অভিযোগ ধামাচাপা দেওয়া, অভিযুক্ত প্রভাবশালী হলে পক্ষ নেওয়া কিংবা ভুক্তভোগীকে চাপ দেওয়ার সুযোগ তৈরি হয়। বাইরের নিরপেক্ষ সদস্য থাকলে এই ঝুঁকি বহুলাংশে কমে আসে। যৌন হয়রানি একটি সংবেদনশীল এবং আইনি বিষয়। জেন্ডার ও নিপীড়ন প্রতিরোধে অভিজ্ঞ বহিঃসদস্যরা তদন্তের সঠিক পদ্ধতি, ভুক্তভোগীর মনস্তাত্ত্বিক অবস্থা এবং আইনের জটিলতাগুলো সঠিকভাবে মোকাবিলা করতে সক্ষম হন। মানবাধিকারকর্মীদের বক্তব্য, এমনিতেই নারীরা সহজে যৌন হয়রানির অভিযোগ করতে চান না। যখন তাঁরা দেখবেন অভিযোগ কমিটি সম্পূর্ণ প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব লোক দিয়ে গঠিত, তখন ন্যায়বিচার পাওয়ার ভরসা হারিয়ে ফেলেন এবং অভিযোগ করা থেকে বিরত থাকেন। তার মানে বাইরের সদস্যের উপস্থিতি ভুক্তভোগীর আস্থা বৃদ্ধি করে।

পোশাক কারখানার মালিকদের একজন নেতার যুক্তি হলো, ‘বাইরের এত উপযুক্ত লোক খুঁজে বের করা কঠিন। তাঁরা যে নারীর পক্ষে কাজ করেন, সেটা কে সাক্ষ্য দেবে! নারী অধিকারভিত্তিক বা নানা সংগঠনের নাম নিয়ে বিদেশের এজেন্ট হয়ে কাজ করতে পারেন কেউ।’ সরকারি দপ্তর থেকে বাইরের কোনো ব্যক্তিকে রাখলে তাঁরা আপত্তি করবেন না বলে জানান তিনি। তবে তাঁর এই যুক্তিগুলো অত্যন্ত দুর্বল এবং কার্যত ন্যায়বিচারকে ব্যাহত করার অজুহাত মাত্র। দেশে জেন্ডার ও আইনগত জ্ঞানে দক্ষ নারীর অভাব নেই। আর সরকারি দপ্তর থেকে সদস্য রাখার প্রস্তাবটিও নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করে না। কারণ, সরকারি দপ্তরগুলোও প্রায়ই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কোনো না কোনো প্রশাসনিক বন্ধনে আবদ্ধ থাকে।

নারীর জন্য এই আইন অত্যন্ত জরুরি। এটি দেশের ইতিহাসে যৌন হয়রানির যথাযথ আন্তর্জাতিক সংজ্ঞাসংবলিত প্রথম আইন হতে চলেছে। কিন্তু যদি আইনের প্রশাসনিক কাঠামোই পক্ষপাতদুষ্ট হওয়ার সুযোগ থাকে, তবে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী সংজ্ঞা নির্ধারণের কোনো মূল্য থাকবে না। অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত কারও কোনো চাপের কাছে নতি স্বীকার না করে আইনের মূল চেতনাকে সমুন্নত রাখা। ‘প্রাপ্যতা সাপেক্ষে’ কথাটি তুলে দিয়ে অভিযোগ কমিটিতে বাইরের নিরপেক্ষ সদস্যের উপস্থিতি বাধ্যতামূলক করতে হবে। নতুবা এই আইন শুধু কাগজে-কলমেই শক্তিশালী থাকবে, বাস্তবে নিপীড়নের শিকার ভুক্তভোগী নারীরা বিচার পাবেন না।