কালো কাপড় সরিয়ে নেওয়া হোক

সম্পাদকীয়

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির সামনে ১৯৯৭ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর যে সন্ত্রাসবিরোধী ভাস্কর্য (রাজু ভাস্কর্য নামে পরিচিত) তৈরি করা হয়েছিল, সেটিই এখন সন্ত্রাসী হামলার শিকার।

১৯৯২ সালে ছাত্রদল ও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকাবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র ও ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় নেতা মঈন হোসেন রাজু। তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে টিএসসিতে সন্ত্রাসবিরোধী রাজু ভাস্কর্য গড়ে তোলা হয়েছিল।

গত বুধবার বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী কার্যক্রম করার অভিযোগ এনে ‘সন্ত্রাসবিরোধী রাজু ভাস্কর্য’ কালো কাপড়ে ঢেকে দিয়েছে ছাত্রলীগ। গত মঙ্গলবার সন্ধ্যার পর পার্বত্য চট্টগ্রামে চার ইউপিডিএফ কর্মী হত্যার প্রতিবাদে গণতান্ত্রিক ছাত্র জোট মিছিল বের করে।

নেতা-কর্মীরা মিছিল শেষে সমাবেশ করতে রাজু ভাস্কর্যের সামনে এলে মিছিল থেকে নেতা-কর্মীদের একটি অংশ প্রধানমন্ত্রীর ছবিসংবলিত মেট্রোরেলের প্রতিকৃতি ভাঙচুর করে। পরে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা তাঁদের ওপর হামলা করেন। এতে গণতান্ত্রিক ছাত্র জোটের কয়েকজন নেতা-কর্মী আহত হন।

এর আগে গণতান্ত্রিক ছাত্র জোটের অন্যতম শরিক ছাত্র ইউনিয়ন বিবৃতি দিয়ে রাজু ভাস্কর্য ঢেকে পড়ায় ছবিটি সরিয়ে ফেলার জন্য ছাত্রলীগকে অনুরোধ করেছিল। ফলে ছাত্রলীগের সব রাগ গিয়ে পড়ে ছাত্র ইউনিয়নের ওপর। তারা কেবল রাজু ভাস্কর্য কালো কাপড় দিয়ে ঢেকে দেয়নি, সেখানে ‘সন্ত্রাসবিরোধী রাজু ভাস্কর্যে ছাত্র ইউনিয়নের সন্ত্রাসী কার্যক্রম’ শিরোনামে একটি ব্যানারও ঝুলিয়ে দেয়।

এরপর গতকাল বৃহস্পতিবার দ্বিতীয় দফা হামলায় গুরুতর আহত ছাত্র ইউনিয়নের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি মেঘমল্লার বসু ও সাধারণ সম্পাদক মাঈন আহমেদ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি আছেন। মেঘমল্লারের বাঁ চোখে গুরুতর আঘাত লেগেছে। এটাই ছাত্রলীগের ক্যাম্পাসে সহাবস্থান নীতির নমুনা!

প্রধানমন্ত্রীর ছবি ভাঙচুর করা নিঃসন্দেহে নিন্দনীয় কাজ। ছাত্রলীগ নেতারা প্রশাসনের কাছে এর প্রতিকার চাইতে পারতেন। প্রয়োজনে আইনের আশ্রয়ও নিতে পারতেন। কিন্তু সেসব না করে তাঁরা গণতান্ত্রিক ছাত্র জোটের কর্মীদের ওপর হামলে পড়লেন কেন? কেনই-বা রাজু ভাস্কর্যটি কালো কাপড় দিয়ে মুড়িয়ে দিলেন?

অন্যদিকে বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে আর সি মজুমদার হলে যে সেমিনারের আয়োজন করেছিল, সেটি খোঁড়া যুক্তিতে বাতিল করে দেয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বলেছে, ‘সেমিনার থেকে সরকার ও রাষ্ট্রবিরোধী বক্তব্য আসতে পারে।’ কিন্তু তাদের জানা উচিত রাষ্ট্র ও সরকার এক নয়। আবার সকারের কোনো নীতির সমালোচনা করার অর্থও সরকারের কর্তৃত্বকে অস্বীকার করা নয়।

শিক্ষাক্রম নিয়ে সেমিনার করতে না দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ প্রমাণ করেছে, তারা চায় না ক্যাম্পাসে জ্ঞানচর্চা হোক, তর্কবিতর্কের মাধ্যমে মানুষ সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছাক। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা যদি শিক্ষাক্রম নিয়ে আলোচনা করতে না পারেন, তাহলে তঁারা কী নিয়ে আলোচনা করবেন? যে বিশ্ববিদ্যালয় একদা সব গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সূতিকাগার হিসেবে পরিচিত ছিল, সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে এ ধরনের নিষেধাজ্ঞা কোনোভাবে মেনে নেওয়া যায় না।

রাজু ভাস্কর্য হলো অন্যায় ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের প্রতীক। সেই প্রতীক যারা কালো কাপড় দিয়ে ঢেকে দিয়েছে, তারা কি তাহলে ক্যাম্পাসে অন্যায় ও সন্ত্রাসকেই জিইয়ে রাখতে চায়? ছাত্রলীগ নিজের উদ্যোগে এই কালো কাপড় সরিয়ে ফেলবে, সেই ভরসা কম।

সে ক্ষেত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে আমাদের দাবি, অবিলম্বে রাজু ভাস্কর্যের কালো কাপড়টি সরিয়ে ফেলা হোক। প্রতিপক্ষ ছাত্রসংগঠনের বিরুদ্ধে অপপ্রচার বন্ধ হোক। ক্যাম্পাসে তখনই সব ছাত্রসংগঠনের সহাবস্থান নিশ্চিত হবে, যখন সেখানে সব সংগঠন নির্বিঘ্নে ও নির্ভয়ে সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারবে।