রাষ্ট্র কি কেবল বড় বড় নগরের উজ্জ্বল আলোয় সীমাবদ্ধ এক নাগরিক পরিসর, যার অন্ধকার প্রান্তগুলোতে মাটিবর্তী মানুষের জীবন কেবল ছায়া হয়ে ঝুলে থাকে? দ্বীপ জনপদ উড়িরচর আজ এই প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছে। প্রশ্নটি নিঃশব্দ; কিন্তু তার প্রতিধ্বনি সমুদ্রের গর্জনের চেয়েও প্রগাঢ়।
প্রথম আলোর প্রতিবেদন বলছে, সাগরের উত্তাল ঢেউয়ের মতো রাষ্ট্রের অবজ্ঞা-উপেক্ষার ঢেউও এই দ্বীপকে ক্ষতবিক্ষত করেছে। ২৫ বছরের ভাঙন কেটে নিয়ে গেছে তার জমি। কেটে নিয়েছে প্রশাসনিক পরিচয়ও। খাতা–কলমে উড়িরচরের এক অংশ পড়েছে চট্টগ্রামে, অন্য অংশ নোয়াখালীতে; কিন্তু প্রকৃতপক্ষে কোথাও নেই উড়িরচর। মানচিত্রের এই অনাথ ভূমি যেন রাষ্ট্রের অবহেলার প্রতিমূর্তি।
উড়িরচরে সর্বশেষ ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন হয়েছিল ২০০৩ সালে। ২০০৭ সালে চেয়ারম্যান খুন হওয়ার পর থেকে একজন সদস্য ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এরপর ২২ বছর ধরে এই দ্বীপে কোনো ইউপি নির্বাচন হয়নি। অথচ আইন স্পষ্ট: চেয়ারম্যানের পদ শূন্য হলে ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন আবশ্যক।
যে গণতন্ত্রের ভিত্তি স্থানীয় সরকারব্যবস্থার শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে থাকার কথা, উড়িরচরে তা স্মৃতিচিহ্নে পরিণত হয়েছে। চেয়ারম্যানহীন ইউনিয়ন, দোকানপাটে চলা ইউপির প্রশাসনিক কাজকর্ম, ভোটাধিকারহীন মানুষ—সব মিলিয়ে এটি এক নীরব নাগরিক বিপর্যয়।
উড়িরচরের সামাজিক অবকাঠামোতেও চরম অবনতিশীল। স্বাস্থ্যসেবার চিত্র ভয়াবহ। একমাত্র স্বাস্থ্যকেন্দ্রটি পুলিশ ফাঁড়িতে রূপান্তরিত হওয়ায় গর্ভবতী মায়ের জীবনহানি থেকে শুরু করে সাধারণ চিকিৎসাসেবার অপ্রাপ্তি এখন সাধারণ ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ অবস্থা জিইয়ে রাখা মানবাধিকার লঙ্ঘনের শামিল।
এখানে শিক্ষাব্যবস্থাও অবহেলিত। মাত্র তিনজন শিক্ষক দিয়ে একমাত্র মাধ্যমিক বিদ্যালয় পরিচালিত হচ্ছে, যার ফলে অল্প বয়সে শিক্ষার্থীদের মূল ভূখণ্ডে যেতে হচ্ছে। এটি শিশুদের মানসিক বিকাশে বিরূপ প্রভাব ফেলছে।
এ অবস্থায় উড়িরচরের দায়বদ্ধতা দেখানোর সময় এসেছে। দ্বীপটির সীমানা পুনর্নির্ধারণ করে অবিলম্বে ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন আয়োজন করতে হবে। মানুষকে তার নিজের প্রতিনিধি নির্বাচনের অধিকার ফিরিয়ে দিতে হবে। স্বাস্থ্যকেন্দ্র পুনর্গঠন, চিকিৎসক নিয়োগ এবং পর্যাপ্ত শিক্ষকের মাধ্যমে বিদ্যালয়গুলোর প্রাণ ফিরিয়ে আনা অপরিহার্য। পাশাপাশি উন্নত যোগাযোগব্যবস্থা ছাড়া এই দ্বীপের নাগরিক অধিকার কেবল কাগজে-কলমেই থেকে যাবে।
উড়িরচর শুধু একটি দ্বীপ নয়, এটি আমাদের রাষ্ট্রচেতনার আয়না। রাষ্ট্র যদি এই দ্বীপকে উদ্ধার না করে, তবে এই অবহেলা একদিন আমাদের মানচিত্রের সীমানাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করবে। উড়িরচর তাই কেবল উন্নয়ন প্রকল্পের দাবি নয়, এটি মানবিকতার পরীক্ষা।