সরকারের ঘুম ভাঙবে কি

সম্পাদকীয়

বাংলাদেশের ব্যবসার পরিবেশ নিয়ে গত রোববার দুটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের গবেষণা জরিপে যেসব তথ্য উঠে এসেছে, তা অত্যন্ত হতাশাজনক। এর মধ্যে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) করেছে ‘বাংলাদেশ: ব্যবসার পরিবেশ ২০২২’ শিরোনামে। আর সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস) করেছে বেসরকারি খাত এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতের দুর্নীতি নিয়ে।

সিপিডির গবেষণায় দুর্নীতি ছাড়াও উঠে এসেছে বেশ কিছু দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো দুর্বল অবকাঠামো, ব্যাংকঋণের অপর্যাপ্ততা, অদক্ষ প্রশাসন, মূল্যস্ফীতি, বৈদেশিক মুদ্রার দামের ওঠানামা, নীতি ধারাবাহিকতার অভাব, জটিল করব্যবস্থা ও উচ্চ করহার, কর্মীদের মধ্যে দুর্বল নীতিনৈতিকতা, শিক্ষিত কর্মীর অভাব, দুর্বল স্বাস্থ্যসেবা, উদ্ভাবনে অপর্যাপ্ত সক্ষমতা।

জরিপে অংশ নেওয়া উদ্যোক্তা ও শীর্ষ কর্মকর্তাদের ৬৪ শতাংশ দুর্নীতিকে প্রধান সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। এরপর দুর্বল অবকাঠামোর কথা বলেছেন ৪৪.৬ শতাংশ, প্রশাসনের অদক্ষতার কথা বলেছেন ৪৩.১ শতাংশ। এ ছাড়া জটিল ও উচ্চ করহারের কথা বলেছেন যথাক্রমে ৩৫.৪ ও ২৪.৬ শতাংশ।

অন্যদিকে সিজিএসের ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের জরিপের তথ্য অনুযায়ী, ৭৮ শতাংশ উদ্যোক্তাকে ব্যবসায়ী সনদ, আইনি সহায়তা নিতে ঘুষ দিতে হয়। তাঁরা রাজনৈতিক প্রভাব ব্যবহার করেন ৬০ শতাংশ ক্ষেত্রে। এর অর্থ হলো ঘুষ না দিয়ে কিংবা রাজনৈতিক প্রভাব না খাটিয়ে ব্যবসা করা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। অর্থনীতিবিদ ও সিপিডির বিশেষ ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য সিজিএসের আলোচনায় একটি মূল্যবান পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছেন, ব্যবসা-বাণিজ্যে দুর্নীতির জন্য সরকারি কর্মকর্তারা যেমন দায়ী, তেমনি ব্যবসায়ীদের ভূমিকাও প্রশ্নবিদ্ধ। তাঁদের একাংশ রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে ও ঘুষ দিয়ে অনৈতিক সুবিধা নিয়ে থাকেন।

সে ক্ষেত্রে ব্যবসার অনুকূল পরিবেশ নিশ্চিত করতে হলে অবকাঠামোগত সুবিধা বাড়ানো এবং প্রশাসনের দুর্বলতা ও বিচ্যুতি কাটানোর পাশাপাশি ব্যবসায়ীদেরও সৎভাবে ব্যবসা করার মানসিকতা থাকতে হবে। রাজনৈতিক প্রভাবে কিছু পাওয়ার চেষ্টা থেকে বিরত থাকতে হবে। যখন যে সরকার আসে, তাদের লোক হয়ে যাওয়ার মানসিকতা থেকে ব্যবসায়ীরা বের হয়ে না এলে ব্যবসার অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করা যাবে না।

সিজিএসের আলোচনা সভায় কোনো কোনো বক্তা রাষ্ট্রব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন আনার ওপর জোর দিয়েছেন। কিন্তু সেই পরিবর্তন না আসা পর্যন্ত আমরা তো হাত গুটিয়ে বসে থাকতে পারি না। অতীতের কথা বাদ দিলেও বর্তমান সরকারের ১৪ বছরে ব্যবসার অনুকূল পরিবেশ ফিরে না এসে থাকলে ক্ষমতাসীনেরা এর দায় এড়াবেন কীভাবে। সিপিডির জরিপে দেখা যায়, ২০২১ সালে ব্যবসার যে পরিবেশ ছিল, ২০২২-এ এসে তার অবনতি ঘটেছে। কাদের কারণে এ অবনতি, কারা ব্যবসার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক ও অনৈতিক প্রভাব খাটাচ্ছেন, তা-ও খুঁজে বের করা প্রয়োজন।

সরকার যদি সিপিডি ও সিজিএসের জরিপ দুটি আমলে নিয়ে প্রতিকারের উদ্যোগ নেয়, তাহলে পুরোপুরি না হলেও ব্যবসা-পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি আশা করা যায়। অবকাঠামো উন্নয়ন খাতে হাজার হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করেও যদি দুর্বল অবকাঠামোর কথা শুনতে হয়, বুঝতে হবে ডাল মে কুছ কালা হায়। যেখানে যে অবকাঠামো প্রয়োজন, সে অবকাঠামো না থাকলে সেসব নির্মাণ করার কী যুক্তি থাকতে পারে!

আর যদি সরকার বরাবরের মতো অস্বীকারের সংস্কৃতি দেখাতে থাকে, তাহলে ব্যবসার সুযোগ-সুবিধা আরও সংকুচিত হবে। ব্যবসাবান্ধব সরকার মুখে বললেই হবে না, কাজেও তা প্রমাণ করতে হবে।