দেশের নদ-নদী রক্ষায় স্থানীয় প্রশাসন যে ভূমিকা রাখার কথা, তা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে না। এখানে বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, ভূমি অফিস কর্মকর্তা আছেন—যথাযথ দায়িত্ব পালনে তাঁদের যথেষ্ট ঘাটতি লক্ষ করা যায়। আবার কোনো কর্মকর্তা নদ-নদী রক্ষায় আন্তরিক হলেও বদলি বা পদোন্নতির কারণে সেটি বাধাগ্রস্ত হয়। এর ফলে নদ-নদী দখল কোনোভাবেই থামছে না। সেখানে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টিসহ সব প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের নেতারা একজোট। যেমনটি আমরা দেখতে পাচ্ছি কুড়িগ্রাম জেলার চাকিরপশার নদের দখলের ক্ষেত্রে।
নব্বই দশক থেকে একের পর এক সড়ক করে চাকিরপশার নদকে একপ্রকার হত্যাই করা হয়েছে। আড়াআড়ি সড়কের কারণে নদীটি এখন বদ্ধ জলাশয়। সড়ক নির্মাণ ও সেতু না থাকায় পানিপ্রবাহ বন্ধ হয়ে সেখানকার হাজার হাজার বিঘার জমিতে চাষও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। সেই জলাশয় জেলা প্রশাসন মাছ চাষের জন্য লিজও দেওয়া শুরু করে।
একসময়ের খরস্রোতা চাকিরপশার নদের জমির বড় অংশটি এখন দখল হয়ে গেছে। নদে অর্ধশত পুকুর করেছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির নেতারা। সেই নদে এখন কেউ মাছ ধরতে নামলে তঁাকে দখলদারদের বাহিনী মারধর করে। স্থানীয় দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের মানুষদের জীবিকার উৎসটি দখল করে নিয়ে সেখানে এভাবে অনাচার চালাচ্ছেন দখলদারেরা। আর সবকিছুই ঘটছে স্থানীয় প্রশাসনের চোখের সামনে। সংশ্লিষ্ট অনেকের ভাষ্য, প্রশাসনের কর্মকর্তারা হয় রাজনৈতিক নেতাদের কাছে নতিস্বীকার করেছেন, নয়তো তাঁদের কেউ কেউ এ দখলবাজির সুবিধাভোগী।
স্থানীয় নদী রক্ষাবিষয়ক সংগঠন রিভারাইন পিপল দীর্ঘদিন ধরে চাকিরপশা রক্ষায় আন্দোলন চালায়। সেখানে দখলদারদের নানা বাধার সম্মুখীন ও হেনস্তার শিকার হয় তারা। স্থানীয় প্রশাসন ও থানা-পুলিশও পরোক্ষভাবে দখলদারদের পক্ষেই অবস্থান নেয়। একপর্যায়ে সংগঠনটির অনড় অবস্থানের কারণে ২০২০ সালে নদটির অবৈধ দখলদারের তালিকা করে জেলা প্রশাসন।
সেই তালিকা জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনকে পাঠিয়ে বলা হয়েছিল, দখলদারদের উচ্ছেদপ্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। কিন্তু দুই বছর পর দেখা গেল, দখল উচ্ছেদ তো হয়নি, উল্টো নদের জমি এখন বেচাকেনা হচ্ছে। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন গত দুই বছরে দখলদার উচ্ছেদের তাগিদ দিয়ে ছয়বার জেলা প্রশাসনকে চিঠি দেয়। তা–ও মানা হয়নি। এমনকি নদ-নদী রক্ষায় হাইকোর্টের নির্দেশনা ছিল, সেটিও মানেনি জেলা প্রশাসন।
নদ-নদী জনগণের সম্পত্তি, যা কোনোভাবেই হস্তান্তরযোগ্য নয়। কিন্তু সেই নদ-নদীর জমি এভাবে দখল ও বেচা-বিক্রি করা হবে, তা কোনোভাবেই মানা যায় না। কারও কোনো তাগিদ বা নির্দেশনা না মেনে কি স্থানীয় প্রশাসন রাজনৈতিক দুর্বৃত্তদের কাছে হার মানল?