গত বৃহস্পতিবার রাজধানীর বেইলি রোডে একটি ভবনে আগুন লেগে ৪৬ জন মর্মান্তিকভাবে মারা যান। যাঁরা সেখানে পরিবারের সদস্য ও বন্ধুদের নিয়ে রাতের খাবার খেতে গিয়েছিলেন, তাঁদের অনেকে ফিরে এলেন লাশ হয়ে। বেশ কয়েকজন অগ্নিদগ্ধ হয়ে হাসপাতালে কাতরাচ্ছেন।
দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক আহমেদ কামরুজ্জামান মজুমদার স্ত্রী ও দুই মেয়েকে নিয়ে সেখানে খেতে গিয়েছিলেন মেয়ের (১২) জন্মদিন উপলক্ষে। আগুন লাগার পর তাঁরা ছাদে আশ্রয় নিয়ে বাঁচতে পারলেও অনেকের পক্ষে তা সম্ভব হয়নি। আগুনে পুড়ে কিংবা ধোঁয়ায় শ্বাসরুদ্ধ হয়ে তাঁরা মারা গেছেন। স্বাস্থ্যমন্ত্রী সামন্ত লাল সেন বলেছেন, অগ্নিদগ্ধ হয়ে যঁারা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন, তাঁরা কেউ শঙ্কামুক্ত নন। সে ক্ষেত্রে মৃত্যুর সংখ্যা আরও বাড়বে।
ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন বেইলি রোডে গিয়ে সাংবাদিকদের বলেন, ভবনটিতে কোনো অগ্নিনিরাপত্তাব্যবস্থা ছিল না। ঝুঁকিপূর্ণ জানিয়ে ভবন কর্তৃপক্ষকে তিনবার চিঠি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) নগর-পরিকল্পনাবিদ ও বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনার (ড্যাপ) প্রকল্প পরিচালক আশরাফুল ইসলাম বলেন, বেইলি রোডের যে ভবনে আগুন লেগেছে, ওই ভবনের কেবল আটতলায় আবাসিকের অনুমোদন নেওয়া হয়েছে। বাকি এক থেকে সাততলা পর্যন্ত বাণিজ্যিক অনুমোদন নেওয়া হলেও সেখানে কেবল অফিস কক্ষ ব্যবহারের জন্য অনুমোদন ছিল। কিন্তু রেস্টুরেন্ট শোরুম বা অন্য কিছু করার জন্য অনুমোদন নেওয়া হয়নি।
এর অর্থ বেইলি রোডের আগুন লাগা ছয়তলা ভবনের মালিক আইনকানুনের তোয়াক্কা করেননি। অগ্নিনির্বাপণব্যবস্থা না রেখে কীভাবে ছয়তলা একটি ভবনে এতগুলো রেস্তোরাঁর দোকান চালু ছিল। প্রতিটি রেস্তোরাঁয় কিচেন থাকে এবং সেখানে রান্না হতো গ্যাস সিলিন্ডারে। বারান্দা ও সিঁড়িঘরেও গ্যাস সিলিন্ডার ছিল বলে অভিযোগ আছে। খুবই ঝুঁকিপূর্ণ গ্যাস সিলিন্ডার থেকে দুর্ঘটনা ঘটলে যে কী ভয়াবহ পরিস্থিতি হতে পারে, বেইলি রোডের ওই ভবনটিই তার প্রমাণ।
ঢাকা শহরে এ ধরনের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা এই প্রথম নয়। এর আগে নিমতলী ও চুড়িহাট্টা ট্র্যাজেডিতেও বহু মানুষ মারা গেছেন। এবার নতুন ঢাকার বেইলি রোডের মতো নিরাপদ এলাকায়ও অগ্নিকাণ্ডে প্রায় অর্ধশত মানুষ প্রাণ হারালেন। যিনি হারিয়েছেন, তিনিই এর বেদনা বোঝেন। আমাদের কোনো সহানুভূতি বা শোকবাণী স্বজনহারা মানুষদের অশ্রু মোছাতে পারবে না।
নিমতলী ও চুড়িহাট্টা ট্র্যাজেডির পেছনে যেমন মানুষ ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সীমাহীন অবহেলা ও উদাসীনতা ছিল, বেইলি রোডেও তা–ই। কিন্তু কিছু মানুষের বা কর্তৃপক্ষের অবহেলার কারণে আমরা বহু মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে পারি না। যখন ব্যক্তিবিশেষের আইন অমান্য করা কিংবা কোনো সংস্থার অবহেলা ও দায়িত্বহীনতার কারণে একের পর এক প্রাণঘাতী ঘটনা ঘটতে থাকে, তখন একে নিছক দুর্ঘটনা বলার সুযোগ নেই। এটা কাঠামোগত হত্যা। বেইলি রোডের ভবনমালিককে তিনবার নোটিশ দেওয়ার পরও যদি তিনি সেখানে অগ্নিনির্বাপণব্যবস্থা না নিয়ে থাকেন, তাহলে এই মৃত্যুর দায়ও তাকে নিতে হবে। রাজউক বলেছে, ভবনমালিক বিনা অনুমতিতে সেখানে রেস্তোরাঁ করেছেন। প্রশ্ন হলো, রাজউক মালিকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিল না কেন?
যাঁদের অবহেলা ও দায়িত্বহীনতার কারণে এতগুলো মানুষের প্রাণ গেল, তাঁদের শাস্তির আওতায় আনতেই হবে। অতীতে চুড়িহাট্টা, নিমতলীর ঘটনা ঘটিয়েও অপরাধীরা পার পেয়ে গেছে। এবার তার পুনরাবৃত্তি কাম্য নয় কোনোভাবে।