বিদ্যুৎ খাতে জবাবদিহি নিশ্চিত করা হোক

সম্পাদকীয়

গ্রীষ্মকালে বিদ্যুতের চাহিদা বেশি থাকায় লোডশেডিংয়ের যন্ত্রণাও বেড়ে যায়; শীতকালে চাহিদা কম থাকায় লোডশেডিংও অপেক্ষাকৃত কম হয়। কিন্তু নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ পাওয়া যাকে বলে, সেটি সাধারণ গ্রাহক কখনোই পান না। তবে ভিভিআইপি গ্রাহকদের কথা আলাদা। জ্বালানিসংকটের বাইরে বিদ্যুৎ খাতের বড় সমস্যা হলো অনিয়ম, দুর্নীতি ও অপচয়।

বিদ্যুৎ বিভাগের নীতি-গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার সেলের জরিপে উঠে এসেছে, নতুন বিদ্যুৎ–সংযোগ পেতে ৮ শতাংশ গ্রাহককে সরকার নির্ধারিত ফি ছাড়াও অতিরিক্ত অর্থ দিতে হয়। আর ১৯ শতাংশের অভিযোগ লোডশেডিং নিয়ে। ১৫ হাজার ২৪৫ জন গ্রাহকের ওপর জরিপটি করা হয়েছে। জরিপে অংশ নেওয়া প্রায় ৯১ শতাংশ গ্রাহক আবাসিক খাতের। অন্যরা শিল্প, বাণিজ্য ও কৃষিসেচ খাতের। জরিপে ইতিবাচক যে দিকটি উঠে এসেছে, সেটি হলো প্রতি মাসে বিদ্যুৎ বিল পরিশোধে অনলাইনের মাধ্যমে বা মুঠোফোনসেবার ব্যবহার বাড়ছে। এ প্রক্রিয়ায় বিল পরিশোধে ৯৯ শতাংশ গ্রাহক সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন।

জরিপে ৩৪ শতাংশ গ্রাহক নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ না পাওয়ার কথা জানিয়েছেন। দিনে গড়ে আধা ঘণ্টা পর্যন্ত বিদ্যুৎ না থাকার কথা জানিয়েছেন ৫৮ শতাংশ গ্রাহক। আর এক ঘণ্টা পর্যন্ত বিদ্যুৎ না থাকার কথা জানিয়েছেন ২১ শতাংশ গ্রাহক। এ ছাড়া বিদ্যুৎসেবা নিয়ে বিতরণ সংস্থার কাছে ফোনে বা সরাসরি গিয়ে নিয়মিত অভিযোগ করেন গ্রাহকেরা। এর মধ্যে প্রায় ৬৪ শতাংশ বিদ্যুৎ–বিভ্রাট আর ৩৪ শতাংশ লোডশেডিং নিয়ে।

বিদ্যুৎ বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব হাবিবুর রহমান বলেন, প্রযুক্তিগত আধুনিকায়ন যত করা যাবে, গ্রাহকের সেবা তত বাড়বে এবং তাঁদের মধ্যস্বত্বভোগীর কাছে যেতে হবে না। কিন্তু প্রযুক্তিগত আধুনিকায়নে কেন বিলম্ব হচ্ছে, তা–ও খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। সারা দেশ দূরের কথা, ঢাকা শহরের সব গ্রাহককে এখনো প্রিপেইড বিলিং-ব্যবস্থায় আনা যায়নি। পোস্টপেইড বিলিং-ব্যবস্থায় চুরি ও দুর্নীতির সুযোগ থাকে। বিল টেম্পারিং করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ারও অভিযোগ আছে।

বিদ্যুতের উচ্চ মূল্য নিয়ে যে ৩৮ শতাংশ গ্রাহক অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন, তার কারণ কেবল জ্বালানিসংকট নয়। সরকার একদিকে বিদ্যুৎ খাতে মোটা অঙ্কের ভর্তুকি দিচ্ছে, অন্যদিকে গ্রাহকদেরও বেশি দামে বিদ্যুৎ কিনতে হচ্ছে। তাহলে ভর্তুকির সুবিধা কারা পাচ্ছেন? সাধারণ গ্রাহক, না ক্যাপাসিটি চার্জের নামে রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিকেরা? ২০১০ সালে রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো করার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল সমস্যার সাময়িক সমাধানের জন্য। কিন্তু সেই সাময়িক ব্যবস্থা এক দশকের বেশি সময় ধরে চলেছে এবং সরকারকে কোটি কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হয়েছে।

সরকারের অন্যান্য খাতের মতো বিদ্যুৎ খাতেও স্বচ্ছ ও জবাবদিহির ঘাটতি আছে। এ ধরনের জরিপ সেই ঘাটতি নিরসনে ভূমিকা রাখতে পারে। যেকোনো খাতের উন্নয়নে গ্রাহক ও সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে নিবিড় যোগাযোগ প্রয়োজন। আশা করি, কর্তৃপক্ষ পাওয়ার সেলের জরিপে উত্থাপিত সমস্যাগুলো সমাধানে সচেষ্ট হবে।

পাওয়ার সেলের জরিপের মাধ্যমে গ্রাহকদের সমস্যা ও অভিযোগ জানা গেল। এখন প্রয়োজন জরিপের সুপারিশগুলো বাস্তবায়নে কার্যকর ও টেকসই পদক্ষেপ নেওয়া। অন্যথায় বিদ্যুৎ খাতের চুরি ও অপচয় যেমন কমবে না, তেমনি গ্রাহকদের অসন্তুষ্টি বাড়তে থাকবে। বিদ্যুৎ খাতের কাজে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত হোক, এটাই প্রত্যাশিত।