চলন্ত ট্রেনে ছিনতাই

সম্পাদকীয়

পৃথিবীর সব দেশেই ট্রেনকে সাশ্রয়ী ও নিরাপদ পরিবহন ভাবা হয়। কিন্তু আমাদের দেশে ঘন ঘন দুর্ঘটনা, ছিনতাই ও পাথর নিক্ষেপের কারণে ট্রেনযাত্রা হয়েছে অনিরাপদ ও ঝুঁকিপূর্ণ।

প্রথম আলোর খবরে বলা হয়, গাজীপুরের টঙ্গীর রেলওয়ে জংশন এলাকায় চট্টগ্রাম থেকে ছেড়ে আসা ‘কর্ণফুলী কমিউটার’ ট্রেনটি বৃহস্পতিবার রাত ১০টার দিকে ছিনতাইকারীদের কবলে পড়ে। জংশনের আউটার সিগন্যালে ট্রেন থামলে হঠাৎ বাইরে থেকে একের পর এক পাথর ছুড়তে থাকে ছিনতাইকারীরা। এতে যাত্রীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। ভিডিওতে দেখা যায়, রাতের বেলা ট্রেনের একটি বগিতে যে যঁার মতো অবস্থান করছেন যাত্রীরা। এর মধ্যেই ট্রেনের জানালা দিয়ে আসতে থাকে একের পর এক ছোড়া পাথর। মুহূর্তেই আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে বগিতে। পাথরের আঘাত থেকে বাঁচতে ট্রেনের মেঝেতে শুয়ে পড়েন যাত্রীদের কেউ কেউ। ট্রেনের একজন টিটিকেও মারধর ও চাকু দিয়ে আঘাত করা হয়। অনেকের মুঠোফোন ছিনিয়ে নেওয়া হয়।

টঙ্গী পূর্ব থানা ও রেলওয়ে পুলিশের ভাষ্য হলো, সিগন্যালে ট্রেন থামলেই রেললাইনের পাশে ওত পেতে থাকা ছিনতাইকারীরা যাত্রীদের মুঠোফোন, স্বর্ণালংকার ছিনিয়ে নেয়। ছিনতাইয়ে বাধা পেলে তারা যাত্রীদের ছুরিকাঘাত করে, পাথর ছুড়ে মারে। ট্রেনের নিয়মিত যাত্রী ও স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, ঢাকার বিমানবন্দর স্টেশন থেকে জয়দেবপুর পর্যন্ত রেলপথ ভ্রমণকারীদের জন্য দিন দিন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে।

গাজীপুরের টঙ্গী স্টেশন থেকে আউটার সিগন্যালটির দূরত্ব প্রায় ১ কিলোমিটার। এই ঝুঁকি কমাতে রেলওয়ে কিংবা থানা-পুলিশ কী করছে? যাত্রীদের নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্ব রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের। বৃহস্পতিবারের ঘটনায় কতজন আক্রান্ত হলেন কিংবা কতটি মোবাইল ফোন খোয়া গেল, সেই হিসাবের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো এই রাষ্ট্রীয় পরিবহনে একের পর এক ছিনতাই ও পাথর নিক্ষেপের ঘটনা ঘটল কীভাবে? রাতের ট্রেনে কোথায় হামলা বা ছিনতাই হয়, সেটা জেনেও রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ কেন নিল না?

ট্রেনে পাথর ছোড়া ও ছিনতাইয়ের ঘটনা এটাই প্রথম নয়। ২০২০ সালে ছিনতাইকারীদের হাতে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় আসার পথে রাকিবুল ইসলাম নামে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের একজন কর্মকর্তা ছিনতাইকারীদের হাতে নিহত হন। ২০১৮ সালে খুলনার বেনাপোল রোডে কমিউটার ট্রেনে দুর্বৃত্তদের ছোড়া পাথরের আঘাতে চলন্ত ট্রেনের পরিদর্শক বায়েজিদ মারাত্মক আঘাত পান এবং ৪১ দিন পর মারা যান। সৈয়দপুরে দুর্বৃত্তদের ছোড়া পাথরে এক ছোট শিশুর চোখ নষ্ট হয়ে যায়।

প্রশ্ন হলো ট্রেনে অহরহ পাথর ছোড়া ও ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটলেও রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ কী করছে? এই রাষ্ট্রীয় পরিবহনেও যদি যাত্রীরা নিরাপদ না থাকেন, নিরাপত্তা কোথায়? চলন্ত ট্রেনে পাথর নিক্ষেপ করা দণ্ডনীয় অপরাধ। রেলওয়ে আইনে ১২৭ ধারা অনুযায়ী সর্বোচ্চ যাবজ্জীবন কারাদণ্ডসহ ১০ হাজার টাকা জরিমানা এবং ৩০২ ধারা অনুযায়ী পাথর নিক্ষেপে কারও মৃত্যু হলে মৃত্যুদণ্ডের বিধান আছে।

বৃহস্পতিবারের ঘটনায় পুলিশ ঘটনার সঙ্গে জড়িত অভিযোগে ৯ জনকে আটক করেছে। পুলিশ কর্মকর্তারাই বলেছেন, এরা আগেও ছিনতাইয়ের অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়েছিল। ছিনতাইকারীদের গ্রেপ্তার ও জেলখানা থেকে বেরিয়ে আসার এই মহড়া কত দিন চলবে? তারা যদি পেশাদার ছিনতাইকারীই হয়, শাস্তি পাবে না কেন? যাত্রীদের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে কোনো অজুহাত চলতে পারে না। যেসব স্থানে ছিনতাই ও পাথর নিক্ষেপের ঘটনা বেশি ঘটে, সেসব স্থানে নিরাপত্তা জোরদার করতে হবে। প্রয়োজনে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলো সিসিটিভি ক্যামেরার আওতায় আনা হোক।