আইন ও কমিশন করতে গড়িমসি কেন

সম্পাদকীয়

কোনো রাজনৈতিক দল নির্বাচনে জয়ী হলে স্বাভাবিকভাবে জনগণ তাদের দেওয়া প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন দেখতে চাইবে। এই প্রেক্ষাপটে ২০১৮ সালের নির্বাচনে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের কাছে দেওয়া আওয়ামী লীগের প্রতিশ্রুতিগুলো বিশ্লেষণ করা যেতে পারে। সম্প্রতি সংখ্যালঘু নেতারা বিভিন্ন সভা–সমাবেশে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পালিত না হওয়ার বিষয়ে উদ্বেগ ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।

উল্লেখ্য, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের ‘সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ’ শিরোনামে প্রকাশিত ইশতেহারে ‘ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃগোষ্ঠী, ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও অনুন্নত সম্প্রদায়’ নামে একটি অনুচ্ছেদ ছিল।

এতে অর্পিত সম্পত্তি সংশোধনী আইন বাস্তবায়ন করে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রকৃত স্বত্বাধিকারীদের অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা, জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশন গঠন, সংখ্যালঘু বিশেষ সুরক্ষা আইন প্রণয়নের কথা বলা হয়েছিল। এ ছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন এবং সমতলের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষের জন্য ভূমি কমিশনের কার্যক্রম অব্যাহত রাখারও প্রতিশ্রুতি ছিল।

বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত প্রথম আলোকে বলেন, সরকার শুধু আশ্বাস দিয়ে যাচ্ছে, প্রতিশ্রুতি রক্ষা করছে না। সংখ্যালঘুদের প্রতি একধরনের অবজ্ঞা ও অবহেলা করার মানসিকতা সরকারের ভেতরের অনেকের মধ্যে রয়েছে। সম্প্রতি তারা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে দুই দিন ধরে অনশন ও অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছেন। এটা মোটেই কাঙ্ক্ষিত নয় যে সরকারের মেয়াদের শেষ দিকে এসেও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে প্রতিশ্রুতি পূরণের দাবিতে আন্দোলন করতে হচ্ছে।

স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন উঠবে, সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষায় আওয়ামী লীগ সরকার কী করেছে। বর্তমান সংসদের চার পঞ্চমাংশের বেশি সদস্য ক্ষমতাসীন দলের। সে ক্ষেত্রে সরকার চাইলে কোনো আইন পাস করা তাদের পক্ষে অসম্ভব নয়। প্রশ্ন হলো তারা প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে চায় কি না?

আওয়ামী লীগের জাতীয় নির্বাচন পরিচালনা কমিটির প্রধান সমন্বয়ক কবির বিন আনোয়ার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগের যে প্রতিশ্রুতি আছে, তার প্রতিটি বিষয় নিয়ে কাজ চলছে। যেমন আইনগুলো প্রণয়ন করা, কোনোটা সংসদে আছে, কোনোটা আইন মন্ত্রণালয়ে আছে, কোনোটা বিল আকারে পেশ করা হয়েছে, কোনোটা ধর্ম মন্ত্রণালয়ে পেন্ডিং (ঝুলে) আছে। কিছুই হয়নি—এটা বলা যাবে না।’

মেয়াদের শেষে এসেও ‘প্রতিশ্রুতির বিষয়ে কাজ হচ্ছে’ বললে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় আশ্বস্ত হবে না। কোনো আইন প্রণয়ন বা কমিশন গঠন করতে পাঁচ বছর সময় লাগার কথা নয়। সাইবার নিরাপত্তা আইনসহ অনেক আইন তো তারা স্বল্প সময়ে সংসদে পাস করেছে।

একই কথা প্রযোজ্য জাতিগত সংখ্যালঘুদের বেলায়ও। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি হয়েছে ২৫ বছর আগে। এখনো সেখানে ভূমি বিরোধ সমস্যার সমাধান হয়নি। এমনকি চুক্তিবিরোধীদের আপত্তির কারণে ভূমি কমিশন বৈঠকও করতে পারছে না। পার্বত্য অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে হলে ভূমি বিরোধের নিষ্পত্তির বিকল্প নেই।

সংখ্যালঘুদের উদ্বেগের আরেকটি কারণ হলো বর্তমান সরকারের আমলে যেসব সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ঘটেছে, তার বিচার না হওয়া। বরং ধর্ম অবমাননার মামলায় অনেক সংখ্যালঘু তরুণ জেল–জুলুমের শিকার হয়েছেন। ২০২১ সালে দুর্গোৎসবের সময় কুমিল্লাসহ বিভিন্ন স্থানে সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর ও মন্দিরে হামলা–ভাঙচুরের ঘটনারও বিচার হয়নি।

ফলে সংখ্যালঘুদের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতা দেখা দেওয়া অস্বাভাবিক নয়। চলতি মাসে একাদশ সংসদের আরও একটি অধিবেশন বসার কথা। সেই অধিবেশনে সরকার অন্তত সংখ্যালঘু কমিশন গঠন করে সদিচ্ছার প্রতিফলন ঘটাক। আসন্ন দুর্গোৎসব কেন্দ্র করে কোনো স্বার্থান্বেষী মহল যাতে আইনশৃঙ্খলার অবনতি না ঘটাতে পারে, সে বিষয়েও সরকারকে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকতে হবে।