প্রাণবৈচিত্র্য ও পরিবেশ রক্ষা করুন

সম্পাদকীয়

টাঙ্গুয়ার হাওর প্রাণবৈচিত্র্য ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য হারালেও স্থানীয় প্রশাসন, বেসরকারি সংগঠন ও হাওরের বাসিন্দাদের নিয়ে গঠিত সমিতিগুলোর নিষ্ক্রিয়তা পীড়াদায়ক।

তাহিরপুর ও ধর্মপাশা উপজেলার ৪টি ইউনিয়নের ১৮টি মৌজাজুড়ে টাঙ্গুয়ার হাওরের অবস্থান। ছোট-বড় ৫৪টি বিল ছাড়াও এই হাওরে জালের মতো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে অসংখ্য খাল। ৮৮টি গ্রামের প্রায় ৬০ হাজার মানুষের জীবন-জীবিকা এই হাওরের ওপর নির্ভরশীল।

উল্লেখ্য, ১৯৯৯ সালে টাঙ্গুয়ার হাওরকে ‘প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা’ ঘোষণা করে সরকার। ২০০১ সালের চুক্তি অনুযায়ী, পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের হাওর এলাকায় উন্নয়নমূলক কার্যক্রম বাস্তবায়ন করার কথা। পাশাপাশি হাওরের মৎস্য সম্পদের সংরক্ষণ, উৎপাদন বৃদ্ধি, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের জন্য তারা স্থানীয় মৎস্যজীবী ও স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে সম্পৃক্ত করবে।

প্রথম আলোর খবর থেকে জানা যায়, হাওর ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব নেওয়ার পর স্থানীয় প্রশাসন কয়েক বছর বেশ সক্রিয় ছিল। এরপরই তাদের কার্যক্রমে ভাটা পড়ে। হাওর তদারকের জন্য আগে দুই থেকে আড়াই হাজার পাহারাদার (ইজারাদারের লোক) ছিলেন। এখন আছেন মাত্র ২৪ জন আনসার সদস্য। এই স্বল্পসংখ্যক আনসার সদস্যকে দিয়ে বিশাল হাওর তদারক করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়।

১২ হাজার ৬৫৫ হেক্টর এলাকাজুড়ে বিস্তৃত এই হাওরে মাছ ও পাখি দুটোই উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমে গেছে। একদা এই হাওর ‘মাদার অব ফিশারিজ’ বা মা হাওর নামে পরিচিত ছিল। সেই হাওরে এখন মাছের আকাল। স্থানীয় লোকজন এখন চাষের মাছের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছেন। টাঙ্গুয়ার হাওর পরিযায়ী পাখিরও নিরাপদ আবাসস্থল। তবে এখন উজানের পলিতে হাওর ভরাট, মাছের আবাসস্থল ধ্বংস, শিকার, রাতে বাতি জ্বালিয়ে মাছ ধরাসহ নানা কারণে পাখির সংখ্যা কমছে।

যেকোনো পর্যটনকেন্দ্রে কিছু বিধিনিষেধ থাকে, টাঙ্গুয়ার হাওরে তার কিছুই মানা হয় না। হাওরের চারদিক থেকেই পর্যটক ঢুকছেন এবং তাঁদের ফেলা পলিথিন ও বর্জ্য পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি করছে। টাঙ্গুয়ার হাওরে স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে নিয়ে গঠিত সহব্যবস্থাপনা কমিটির সাবেক সভাপতি আহমদ কবির প্রথম আলোকে বলেন, হাওরের কোনো কোনো এলাকায় কিছু গাছ লাগানো হয়েছে। তবে মৎস্য সম্পদের উন্নয়নে বিগত দিনে হাওরে কোনো অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়নি।

টাঙ্গুয়ার হাওরকে ‘প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা’ ঘোষণা করলেই এর দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। টাঙ্গুয়ার হাওরের প্রধান সম্পদ এর প্রাকৃতিক পরিবেশ, মাছ, পাখি, গাছ রক্ষা করতে হবে। ভাবতে হবে স্থানীয় বাসিন্দাদের জীবিকার কথাও। তাদের নিরাপদ ও নিশ্চিত জীবিকার জন্য এখানে মাছের প্রজনন বৃদ্ধি এবং এর জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করা প্রয়োজন। এ ছাড়া নির্বিচার মাছ মারা রোধ করতে তাদের মধ্যে সচেতনতাও বৃদ্ধি করতে হবে। আর মাছ ও জলজ উদ্ভিদ না থাকলে সেখানে পাখিও আসবে না।

সাম্প্রতিক কালে টাঙ্গুয়ার হাওরে পর্যটকদের ভিড় বাড়ছে। এটা একদিকে আনন্দের, অন্যদিকে উদ্বেগেরও। আনন্দের এ কারণে আমাদের অনেক পর্যটনকেন্দ্র প্রাকৃতিক সৌন্দর্য হারানোয় পর্যটকেরা যেতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। উদ্বেগের কারণ হলো, পর্যটকেরা নীতিমালা মানেন না। তাঁরা যত্রতত্র প্লাস্টিক বর্জ্য, পলিথিন ইত্যাদি ফেলে রাখেন। পলিথিন যে ভয়াবহভাবে পরিবেশদূষণ করে, তা আমরা প্রতিটি পর্যটনকেন্দ্রে লক্ষ করেছি। এ ক্ষেত্রে সার্বক্ষণিক নজরদারি প্রয়োজন। যাঁরা নীতিমালা মানবেন না, তাঁদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। পর্যটকের প্রবেশপথগুলোও নির্দিষ্ট করতে হবে। প্রবেশপথ নির্দিষ্ট করা থাকলে পর্যটকের ওপর নজর রাখা সহজ হয়।

টাঙ্গুয়ার হাওর রক্ষা করতে যথাযথ ও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হোক। সেখানে সম্পৃক্ত করতে হবে জেলা ও উপজেলা প্রশাসন, জেলা ও উপজেলা পরিষদ, তৃণমূল প্রতিনিধি, বেসরকারি সংস্থা–সমিতি সবাইকে। সমন্বিত ও সম্মিলিতভাবে পদক্ষেপ না নিলে এ হাওরের বিপর্যয় ঘটবে।