প্রকল্পের তথ্য দিতে এত গড়িমসি কেন

সম্পাদকীয়

যেখানে সরকারি কাজে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি থাকে, সেখানে তথ্য দিতে সমস্যা হওয়ার কথা নয়। স্বাভাবিকভাবে কোনো সরকারি কর্মকর্তা কিংবা কর্তৃপক্ষ তথ্য দিতে গড়িমসি করলে ধরে নিতে হবে এর মধ্যে রহস্য আছে।

নাগরিকের তথ্য পাওয়া নিশ্চিত করতেই ২০০৯ সালে সরকার তথ্য অধিকার আইন পাস করে। এই আইনে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি নয়, এমন সব তথ্য নাগরিককে দিতে সংশ্লিষ্ট সংস্থা বাধ্য থাকবে।

কিন্তু আমাদের সরকারি কর্মকর্তাদের মনোভাবটা হলো, সরকারি তথ্য লুকিয়ে রাখতে হবে, কাউকে দেওয়া যাবে না। ২০ মে প্রথম আলোর প্রতিবেদনে দেখা যায়, বিভিন্ন প্রকল্প ও অর্থ বরাদ্দ-সংশ্লিষ্ট তথ্য দিতে বেশি গড়িমসি করেন সরকারি কর্মকর্তারা। জাতীয় সংসদে জমা দেওয়া তথ্য কমিশনের ২০২৩ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ওই বছর সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করে তথ্য না পেয়ে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তিরা তথ্য কমিশনে মোট ৬৮৬টি অভিযোগ করেন। এর মধ্যে ৩২৪টি অভিযোগ আমলে নেয় কমিশন। সবচেয়ে বেশি, ৫২টি অভিযোগ আসে প্রকল্পসংক্রান্ত তথ্য না পেয়ে। বরাদ্দসংক্রান্ত তথ্য চেয়ে না পেয়ে কমিশনে অভিযোগ আসে ২৯টি।

এ ছাড়া দরপত্রসংক্রান্ত ১৭টি, নিয়োগসংক্রান্ত ১২টি তথ্য না পেয়ে অভিযোগ আসে। মোট ১০৬ ধরনের তথ্য না পেয়ে অভিযোগ এসেছে তথ্য কমিশনে। ২০২২ সালে কমিশন ৩৬০টি অভিযোগ আমলে নিয়েছিল। এর মধ্যে সরকারি বরাদ্দ ও খাতওয়ারি ব্যয়সংক্রান্ত অভিযোগ ছিল ২৫টি, প্রকল্পসংক্রান্ত ছিল ২৩টি। অর্থাৎ সরকারি কর্মকর্তাদের তথ্য লুকানোর প্রবণতা বেড়েছে।

প্রথম আলোর প্রতিবেদনে খাগড়াছড়ির এক নাগরিক ও শেরপুরের এক সাংবাদিকের অভিজ্ঞতা তুলে ধরা হয়েছে। খাগড়াছড়ির সড়ক ও জনপথ বিভাগের অধীন পাঁচটি অর্থবছরের উন্নয়নমূলক প্রকল্পের কিছু সুনির্দিষ্ট তথ্য চেয়ে ২০২৩ সালের ১০ এপ্রিল জেলার নির্বাহী প্রকৌশলী এবং দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার (আরটিআই) কাছে আবেদন করেন ওই নাগরিক। কিন্তু তাঁকে তথ্য দেওয়া হয়নি। তাঁর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে কমিশন তথ্য সরবরাহকারী কর্মকর্তাকে তথ্য দিতে এবং নির্বাহী প্রকৌশলীকে ভবিষ্যতে সতর্ক হওয়ার নির্দেশ দেন।

গত মার্চে শেরপুরের নকলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কার্যালয়ে তথ্য চাইতে গিয়ে সাংবাদিক শফিউজ্জামান কারাদণ্ডের শিকার হন। তথ্য অধিকার কমিশন ইউএনওর বিরুদ্ধে বিভাগীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করে।

আমরা কমিশনের এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাই। সেই সঙ্গে এ কথাও বলব যে কেবল নির্দেশনা তথ্য পাওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়। যঁারা নির্দেশনা মানবেন না, তাঁদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে। অতীতে বেশ কিছু ঘটনায় কমিশন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে জরিমানা করেছে।

বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে যাঁরা আছেন, তাঁদের বুঝতে হবে, তথ্য পাওয়া নাগরিকের মৌলিক অধিকার। সেই অধিকার থেকে বঞ্চিত করার এখতিয়ার কারও নেই। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের তথ্য জনগণের সম্পদ, পদাধিকারীদের নয়।

সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিয়ে প্রশ্ন আছে। সেই প্রশ্নের সদুত্তর তখনই পাওয়া যাবে, যখন সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান তথ্য সরবরাহ নিশ্চিত করবে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেছেন, দেশে দুর্নীতির যেসব ক্ষেত্র আছে, তার অন্যতম উন্নয়ন প্রকল্পগুলো ঘিরে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা যদি এতই সাধু হয়ে থাকবেন, তথ্য দিতে গড়িমসি করেন কেন?

তথ্য অধিকার কমিশনের প্রতিবেদনে উল্লিখিত প্রতিটি ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তির আওতায় আনা হোক।