রোজার আগে কাঁচামাল জোগান নিশ্চিত করুন

সম্পাদকীয়

গত কয়েক মাসে দাম কয়েক দফা বাড়িয়ে এবং বাজার নিয়ন্ত্রণে অভিযান পরিচালনা করেও চিনির বাজারে অস্থিরতা কাটানো যাচ্ছে না। গত বছরের জুলাই-আগস্ট মাসের অস্থিরতার পর সেপ্টেম্বর মাসে প্রথম চিনির দাম বেঁধে দেয় সরকার। এরপর দুই দফায় দাম বাড়ানোও হয়।

কিন্তু চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম থাকায় গত কয়েক দিনে চিনির বাজার নতুন করে অস্থিতিশীল হয়ে পড়েছে। প্যাকেটজাত চিনি বাজারে মিলছে না বললেই চলে। আর খোলাবাজারে চিনি মিললেও বিক্রেতারা তা ইচ্ছেমতো দামে ভোক্তাদের কাছে বিক্রি করছেন।

কোভিড মহামারি-পরবর্তী বৈশ্বিক অর্থনীতি পুনরুদ্ধার কর্মসূচি এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে যে ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি হয়, তাতে দেশে ডলার ও জ্বালানি-সংকট সৃষ্টি হয়। এ বাস্তবতায় বাজার অস্থিতিশীল হলে চিনি আমদানি ও পরিশোধনের সঙ্গে যুক্ত কোম্পানিগুলো জানিয়েছিল তাদের কাছে পর্যাপ্ত কাঁচামাল রয়েছে।

সেই কাঁচামাল দিয়ে ‘নিয়ন্ত্রিত’ হলেও গত কয়েক মাসে বাজারে চিনির সরবরাহ নিশ্চিত করা হয়েছে। কিন্তু অক্টোবর-নভেম্বর মাসের তুলনায় ডিসেম্বর মাসে চিনির আমদানি উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, অক্টোবর মাসে যেখানে অপরিশোধিত চিনি আমদানি হয়েছে প্রায় ১ লাখ ৬৪ হাজার টন, সেখানে ডিসেম্বর মাসে আমদানি হয়েছে মাত্র ৬৯ হাজার টন।

ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলে প্রতিষ্ঠিত চিনিকলগুলো দেশীয় কাঁচামালনির্ভর হলেও আধুনিকায়ন না হওয়ায় এর উৎপাদনশীলতা কম। বছরে যেখানে চিনির চাহিদা ১৮-২০ লাখ টন, সেখানে দেশে বড়জোর ৩০-৩৫ হাজার টন উৎপাদন হয়। আমদানিনির্ভর চিনির বাজার নিয়ন্ত্রণ করে মূলত পাঁচটি কোম্পানি। নতুন বছরে এসে চিনির বাজার নতুন করে অস্থিতিশীল হওয়ার পেছনে বিশ্ববাজার পরিস্থিতির সঙ্গে ও অভ্যন্তরীণ কারণও রয়েছে।

ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে এ বছর চিনির সবচেয়ে বড় উৎপাদক দেশ ব্রাজিলে উৎপাদন কম হয়েছে। আর দেশে ডলার-সংকটের কারণে ঋণপত্র খুলতে হিমশিম খাচ্ছেন আমদানিকারকেরা। ফলে সরকারের বেঁধে দেওয়া দামে বাজারে চিনি সরবরাহ করতে সমস্যায় পড়ছেন চিনিকলমালিকেরা।

স্বাভাবিক অবস্থায় চিনির যে চাহিদা, রোজার সময় তা বেড়ে যায়। আসন্ন পবিত্র রমজান মাস সামনে রেখে ভোগ্যপণ্যের বাজার স্থিতিশীল রাখতে আগেভাগেই উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। গত ডিসেম্বর মাসে চিনিসহ আট পণ্যের ক্ষেত্রে কম টাকা জমা দিয়ে ব্যবসায়ীরা যাতে ঋণপত্র খুলতে পারেন, সেই নির্দেশ দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সেই নির্দেশনা যে খুব একটা বাস্তবায়ন হচ্ছে না, তা বাজার পরিস্থিতিই বলে দিচ্ছে।

কোভিড মহামারি ও ইউক্রেন যুদ্ধ আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে আমদানিনির্ভর অর্থনীতির গলদটা কোথায়। যেসব ভোগ্যপণ্যের কাঁচামাল দেশে উৎপন্ন হয়, সেই ধরনের শিল্পকারখানার বিকাশের সুযোগ তৈরির জন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নেওয়া প্রয়োজন।

কিন্তু চিনির বাজারে চলমান যে সংকট, তার সুরাহার জন্য সরকারকে বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। জরুরি ভিত্তিতে চিনি আমদানির ক্ষেত্রে ঋণপত্র খোলার অসুবিধা দূর করা না গেলে রমজান মাসে পরিস্থিতি আরও অবনতি হওয়ার শঙ্কা রয়েছে।

এমনিতেই আমাদের ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর একাংশের মধ্যে সিন্ডিকেট গড়ে বাজার অস্থিতিশীল করার রেওয়াজ রয়েছে। কোনো অবস্থাতেই ভোক্তার পকেট কেটে এ ধরনের অসাধু ব্যক্তিদের অতিরিক্ত মুনাফা করার সুযোগ দেওয়া যাবে না। চিনির মিলগুলোতে যাতে কাঁচামালের জোগান অব্যাহত থাকে, সেটি নিশ্চিত করতে হবে।

চিনি ও অন্যান্য ভোগ্যপণ্য আমদানির ক্ষেত্রে ঋণপত্র খুলতে গিয়ে ব্যবসায়ীরা যাতে সমস্যায় না পড়েন, সে জন্য পবিত্র রমজান মাস শুরুর আগেই কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে সরকারকে।

বাজারে নিত্যপণ্যের সংকট যাতে সৃষ্টি না হয়, সে জন্য তদারকিব্যবস্থা শক্তিশালী করতে হবে। বাজারে সংকট সৃষ্টির পেছনে দায়ী ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।