অভিযোগের পরও প্রশাসন কেন ব্যবস্থা নেয়নি

সম্পাদকীয়

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ফাইরুজ সাদাফ ওরফে অবন্তিকার আত্মহত্যার বিষয়টি যেমন মর্মান্তিক, তেমনি আমাদের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোয় ছাত্রীদের নিরাপত্তাহীনতার দিকটিও প্রকটভাবে তুলে ধরেছে। তিনি ছিলেন আইন বিভাগের ১৩তম ব্যাচের শিক্ষার্থী।

আত্মহত্যার আগে ফাইরুজ সাদাফ যে চিরকুট লিখে গেছেন, তাতে তিনি তাঁর সহপাঠী আম্মান সিদ্দিকী ও সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলামকে দায়ী করেছেন। তাঁর ভাষ্য হলো, ‘এটা সুইসাইড না, এটা মার্ডার। টেকনিক্যালি মার্ডার।’ একজন ছাত্রী কী ভয়ংকর অবস্থার মুখোমুখি হলে আত্মহত্যা করতে পারেন, সেটা উপলব্ধি করা কঠিন নয়।

ফাইরুজ সাদাফ গত বছরের ১৪ নভেম্বর সহপাঠী আম্মান সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে উত্ত্যক্ত করা ও হয়রানির অভিযোগ করে তৎকালীন প্রক্টরের কাছে প্রতিকার চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি প্রতিকার পাননি। এ বিষয়ে প্রক্টর যে অজুহাত দেখাচ্ছেন, সেটা দায়িত্ব এড়ানোর ব্যর্থ প্রয়াস ছাড়া কিছু না। সাবেক উপাচার্য তাঁকে (প্রক্টর) অভিযোগকারীর সঙ্গে আলোচনা করার পরামর্শ দেওয়ার অর্থ এই নয় যে তিনি অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেবেন না। অভিযোগকারীর সঙ্গে আলোচনার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো বিশ্ববিদ্যালয় আইন অনুযায়ী অভিযুক্ত ব্যক্তিদের কাছে কৈফিয়ত তলব করা। সেটা তিনি কেন করলেন না?

ফাইরুজ সাদাফের মায়ের মামলায় আম্মান সিদ্দিকী ও দ্বীন ইসলামকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে নিয়েছে। পুলিশের দাবি, তাঁদের দুজনের বিরুদ্ধে অভিযোগের আংশিক সত্যতা পাওয়া গেছে। ঘটনার পর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আম্মান সিদ্দিকীকে সাময়িক বহিষ্কার এবং দ্বীন ইসলামকে সাময়িক বরখাস্ত করার পাশাপাশি পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটিও গঠন করেছে। কিন্তু হয়রানি ও নির্যাতনের শিকার একজন শিক্ষার্থী লিখিত অভিযোগ করার পরও চার মাসেও কেন পদক্ষেপ নেওয়া হলো না, সেই প্রশ্নের জবাব নেই।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ফাইরুজ সাদাফই একমাত্র নন, আরও শিক্ষার্থী যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন। তাঁর আত্মহত্যার পর আরেক শিক্ষার্থী বেসরকারি টেলিভিশনে দেওয়া সাক্ষাৎকারে যৌন হয়রানির শিকার হওয়ার কথা জানিয়েছেন। অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ক্ষেত্রেও অভিযোগের কমতি নেই। কবি নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রীকে যৌন হয়রানির প্রতিবাদে দুই শিক্ষকের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছেন শিক্ষার্থীরা। একই অভিযোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক শিক্ষকের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়েও প্রক্টরকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।

২০০৯ সালে উচ্চ আদালত বিশ্ববিদ্যালয় ও সব কর্মস্থলে যৌন নিপীড়নবিরোধী সেল গঠন করার যে নির্দেশ দিয়েছিলেন, অনেক প্রতিষ্ঠানই তা মানেনি। আবার কোথাও সেল গঠিত হলেও তা অকার্যকর। অনেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েই যৌন নিগ্রহের ঘটনা ঘটলেও প্রতিকার পাওয়া যায় না। শিক্ষাজীবন অনিশ্চিত হয়ে যেতে পারে, এই ভয়ে অনেক নারী শিক্ষার্থী নিগ্রহের শিকার হয়েও মুখ খোলেন না। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে নারীদের চলাফেরা ও পোশাক–আশাকের ওপর অলিখিত বিধিনিষেধ আছে।

ফাইরুজ সাদাফ আত্মহত্যার পর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করছেন নিরাপদ ক্যাম্পাস ও ন্যায়বিচারের দাবিতে। তাঁদের এই আন্দোলনের প্রতি আমাদের দৃঢ় সমর্থন আছে। বিশ্ববিদ্যালয় কোনো ধর্ষক কিংবা যৌন নিগ্রহকারীর জায়গা হতে পারে না। প্রত্যেক ছাত্রীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।

কোনো বিচারই ফাইরুজ সাদাফকে ফিরিয়ে আনতে পারবে না। কিন্তু অপরাধীরা শাস্তি পেলে ভবিষ্যতে হয় তো আর কোনো শিক্ষার্থীকে এভাবে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে হবে না। জগন্নাথসহ সব বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে আমাদের আহ্বান, ধর্ম–বর্ণ, নারী–পুরুষনির্বিশেষে সব শিক্ষার্থী যাতে ক্যাম্পাসে নিরাপদ থাকতে পারেন, সেই পরিবেশ নিশ্চিত করুন।