যাত্রী নিরাপত্তায় রেল কর্তৃপক্ষ কী করছে

সম্পাদকীয়

শুক্রবার গাজীপুরের জয়দেবপুর স্টেশনে মালবাহী ট্রেনের সঙ্গে যাত্রীবাহী ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষের পর রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ এর লাইন মেরামতে সময় লাগিয়েছে ৩১ ঘণ্টার বেশি। ফলে ট্রেনযাত্রীরা চরম ভোগান্তিতে পড়েন। প্রচণ্ড গরমে অনেক যাত্রীকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা রেলস্টেশনে অপেক্ষা করতে হয়েছে।

জয়দেবপুরে টাঙ্গাইল কমিউটার ও মালবাহী ট্রেনের সংঘর্ষ হয় সিগন্যালম্যানের ভুলের কারণে। এতে কমিউটার ট্রেনের লোকোমাস্টারসহ (ট্রেনের চালক) চারজন আহত হন। পরদিন শনিবার বঙ্গবন্ধু যমুনা সেতুতে দুটি ট্রেন মুখোমুখি সংঘর্ষ থেকে রেহাই পায় এক চালকের বুদ্ধিমত্তার কারণে। ওই দিন বেলা সোয়া দুইটার দিকে কলকাতা থেকে ঢাকাগামী মৈত্রী এক্সপ্রেস ট্রেনটিকে নতুন নির্মিত ৫ নম্বর লাইনে প্রবেশ করে অপেক্ষমাণ অবস্থায় দাঁড়িয়ে রাখা হয়। এ সময় ঢাকা থেকে রাজশাহীগামী ধূমকেতু এক্সপ্রেস ট্রেন ৪ নম্বর লাইনে প্রবেশ করানোর নির্দেশ দিলেও স্টেশনমাস্টার ও পয়েন্টসম্যান ভুল করে ৫ নম্বর লাইনে প্রবেশ করান। ধূমকেতু এক্সপ্রেসের চালক লাইনে আরেকটি ট্রেন দেখে দ্রুত নিজের ট্রেনটি থামিয়ে দেন।

সাম্প্রতিক কালে বেশ কিছু ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটল, কোনোটি ভুল সিগন্যালের কারণে, কোনোটি বগি লাইনচ্যুত হয়ে, কোনোটি রেলক্রসিংয়ে বার না থাকায়। এসব দুর্ঘটনার জন্য কাউকে কি শাস্তি পেতে হয়েছে? কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ নিয়মমাফিক তদন্ত কমিটি করে, কমিটি প্রতিবেদনও জমা দেয়; কিন্তু সেই প্রতিবেদনে কী আছে, জনগণ জানতে পারে না। এই ধারাই চলে আসছে বহু বছর ধরে।

প্রতিবেশী ভারত ট্রেনকে সবচেয়ে সাশ্রয়ী, নিরাপদ ও লাভজনক বাহন করতে পেরেছে। কিন্তু আমরা পারলাম না কেন? এর জন্য সরকারের ভুল নীতি যেমন দায়ী, তেমনি রেলওয়ের কর্তাব্যক্তিদের অদক্ষতা ও অবহেলা। ২০২২-২৩ অর্থবছরে রেলওয়ের ব্যয় ছিল ৩ হাজার ৩০৭ কোটি টাকা, অন্যদিকে রেলওয়ের আয় ছিল ১ হাজার ৭৮৩ কোটি টাকা। আয়ের তুলনায় ১ হাজার ৫২৪ কোটি টাকা ব্যয় বেশি হয়েছে। প্রথম আলোর খবর থেকে জানা যায়, ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটলে দ্রুত সময়ে উদ্ধারকারী ট্রেন নেই রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের কাছে। যে কটি উদ্ধারকারী ট্রেন আছে, সেগুলোও পুরোনো।

বিপুল অঙ্কের অর্থ খরচ করার পরও যদি রেলওয়ে নিজস্ব নিরাপত্তাব্যবস্থা এবং দক্ষ জনবল তৈরি করতে না পারে, ট্রেনকে কীভাবে তারা নিরাপদ বাহন করবে? অতীতে রেলওয়ের বিরুদ্ধে অনেক ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত হয়েছে। কোনো কোনো রুটে ট্রেন যোগাযোগ বন্ধ করার দাবিতে সড়ক পরিবহনমালিক ও শ্রমিকেরা আন্দোলনও করেছেন। এখনো ট্রেনের সময়সূচি তৈরির ক্ষেত্রে কারসাজির অভিযোগ আছে। এমন সময়ে ট্রেনের সময়সূচি দেওয়া হয়, যা যাত্রীদের জন্য সুবিধাজনক নয়। ফলে তাঁরা সড়ক পরিবহনে যেতে বাধ্য হন।

গণপরিবহনবিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ট্রেন দুর্ঘটনার উদ্ধারকাজ চ্যালেঞ্জিং। কিন্তু ৩১ ঘণ্টা অনেক বেশি সময়। এর অর্থ হচ্ছে উদ্ধারের যন্ত্রপাতি ও লোকবলের সক্ষমতার ঘাটতি আছে।

এই ঘাটতি দূর করতে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিয়েছে বলে আমাদের জানা নেই। এরই মধ্যে তারা রেয়াত সুবিধা তুলে দেওয়ার নামে যাত্রী ভাড়া বাড়িয়ে দিয়েছে, যেটা মোটেই যৌক্তিক নয়। অথচ রেলযাত্রাকে নিরাপদ করতে ব্যর্থ হচ্ছে। সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশের পর এখন স্মার্ট বাংলাদেশ তৈরির কথা বলছে, আর আমাদের রেলওয়ে চলছে ম্যানুয়াল সিগন্যালে। এ অবস্থায় রেলওয়ের উন্নয়ন কিংবা যাত্রীদের নিরাপত্তা কোনোটাই আশা করা যায় না।