সন্ত্রাসী সংগঠনের তৎপরতা বন্ধ হোক 

সম্পাদকীয়

২০১৭ সালে মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত সাত লাখের বেশি শরণার্থীকে বাংলাদেশ আশ্রয় দিয়েছিল সম্পূর্ণ মানবিক কারণ। অবশ্য এর আগে থেকেই এখানে প্রায় চার লাখ রোহিঙ্গা ছিল। আশা করা গিয়েছিল, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তাদের দেশে প্রত্যাবর্তনে কার্যকর ভূমিকা নেবে। এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনো সুসংবাদ নেই। মাঝখানে চীনের দূতিয়ালিতে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে যে পাইলট প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল, তা-ও থমকে আছে যৌক্তিক কারণেই।

রোহিঙ্গারা কেবল আমাদের দেশের অর্থনীতি ও সামাজিক পরিবেশেই অভিঘাত সৃষ্টি করেনি, জননিরাপত্তার জন্যও মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। উদ্বেগের বিষয় হলো, রোহিঙ্গা শিবিরগুলো অবৈধ অস্ত্র ও মাদকের রমরমা ব্যবসার পাশাপাশি মিয়ানমারের সন্ত্রাসী সংগঠন আরাকান স্যালভেশন আর্মি (আরসা) ও আরাকান সলিডারিটি অর্গানাইজেশনের (আরএসও) ‘যুদ্ধক্ষেত্রে’ পরিণত হয়েছে। অনেক সময় তারা বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গেও সংঘাতে লিপ্ত হচ্ছে।

৭ জুলাই কক্সবাজারের উখিয়া ক্যাম্প ৮-এ আরএসও ও আরসার মধ্যকার সংঘর্ষে পাঁচজন নিহত হন। এরপর আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) সদস্যরা ওই শিবিরে অভিযান চালালে আরসার সন্ত্রাসীরা পাল্টা আক্রমণ করেন। দুই পক্ষের বন্দুকযুদ্ধে আরসা নেতা হোসেন মাঝি মারা যান। তিনি ছিলেন আরসার অন্যতম শীর্ষস্থানীয় নেতা। গত ছয় বছরে বিভিন্ন রোহিঙ্গা শিবিরে সংঘর্ষে কয়েক শ রোহিঙ্গা মারা গেছে। বাংলাদেশ মানবিক কারণে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছে। এর অর্থ এই নয় যে সেখানকার সন্ত্রাসী সংগঠন বাংলাদেশের ভূখণ্ডে বসে খুনোখুনি করবে। প্রশ্ন হলো আরসা ও আরএসওর মতো সন্ত্রাসী সংগঠন বাংলাদেশে ঘাঁটি গাড়ল কীভাবে? 

বাংলাদেশে আশ্রয়প্রার্থী রোহিঙ্গাদের মধ্যে বড় দাগে দুটি গ্রুপ তৈরি হয়েছে। এর একটি প্রত্যাবাসনে আগ্রহী, অন্যটি প্রত্যাবাসনবিরোধী। ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে উখিয়ার শিবিরে প্রত্যাবাসনকামীদের নেতা মুহিবুল্লাহ আরসা সন্ত্রাসীদের হাতে খুন হন। 

রোহিঙ্গা শিবির ঘিরেই আরসা ও আরএসও নেতা-কর্মীদের তৎপরতা। কীভাবে তারা সেখানে ঘাঁটি গাড়ল, কীভাবে অস্ত্র আমদানি হলো, সেসব খুঁজে বের করতে হবে। অন্যথায় একটি বা দুটি অভিযান চালিয়ে সেখানে সন্ত্রাসী তৎপরতা বন্ধ করা যাবে না। কক্সবাজার ১৪ এপিবিএনের অধিনায়ক (অতিরিক্ত ডিআইজি) সৈয়দ হারুন অর রশীদ বলেছেন, আরসা নেতা হোসেন মাঝির নির্দেশে কক্সবাজারের সাত থেকে আটটি শরণার্থীশিবিরে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হতো। হোসেন মাঝির মৃত্যুর পর তাঁর সহযোগীদেরও খুঁজে বের করতে হবে। রোহিঙ্গা শিবিরে কারা তাদের আশ্রয়–প্রশ্রয় দিচ্ছেন, সেটাও খতিয়ে দেখা দরকার। 

রোহিঙ্গা শিবিরে সন্ত্রাসী কার্যক্রমের সঙ্গে মাদক ব্যবসারও নিবিড় সম্পর্ক আছে। ২০১৭ সালে যখন রোহিঙ্গারা এখানে আশ্রয় নেয়, কেউ অস্ত্র নিয়ে আসেনি। পরে সেখানে মাদকের সঙ্গে অস্ত্রও আসে। গত ছয়–সাত বছরে তো রোহিঙ্গা শিবিরগুলো মাদক ও অস্ত্র ব্যবসার ঘাঁটিতে পরিণত হয়েছে। আর এই মাদক ব্যবসার সঙ্গে কেবল রোহিঙ্গা নয়, বাংলাদেশি নাগরিকেরাও জড়িত। কক্সবাজারে মাদকের বিরুদ্ধে এত অভিযান, এত বন্দুকযুদ্ধ হলো, এত মানুষ মারা গেল, তারপরও কেন মাদকের বিস্তার রোধ হলো না? সরষের ভেতরে ভূতটা কোথায়, তা-ও খুঁজে দেখা দরকার। 

সন্ত্রাসী তৎপরতা, বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠীর কার্যক্রম ও মাদক ব্যবসা—সব মিলিয়ে রোহিঙ্গা শিবিরগুলো বিপজ্জনক স্থানে পরিণত হয়েছে। এটা আমাদের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য গুরুতর হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। রোহিঙ্গা শিবিরের বর্তমান পরিস্থিতিকে তাই হালকাভাবে দেখার সুযোগ নেই। মনে রাখতে হবে, ভূরাজনৈতিকভাবেও ওই অঞ্চল গুরুত্বপূর্ণ। রোহিঙ্গা শিবিরগুলো যাতে কোনো স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী ব্যবহার করতে না পারে, তা নিশ্চিত করার প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া জরুরি হয়ে পড়েছে। সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর সব ধরনের কার্যক্রমকে সমূলে উৎপাটনের পাশাপাশি মাদক কারবারিদের বিরুদ্ধেও অভিযান অব্যাহতভাবে চালিয়ে যেতে হবে।