শিশুদের রক্ষায় একযোগে কাজ করতে হবে

সম্পাদকীয়

শিশুদের মানসিক বিকাশের জন্য প্রয়োজন সুস্থ ও সুন্দর পরিবেশ, যা তাদের সব ক্লেদ, কলুষতা ও যন্ত্রণা থেকে দূরে রাখবে। আগে শিশুরা কাছের অন্য শিশু কিংবা বয়স্কদের হাতে সরাসরি নিগ্রহের শিকার হতো। সাম্প্রতিক কালে ইন্টারনেটেও তাদের নানা রকম নিগ্রহ ও হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে।

১২ জুন সেন্টার ফর উইমেন অ্যান্ড চিলড্রেন স্টাডিজ (সিডব্লিউসিএস) আয়োজিত আলোচনা সভায় অনলাইনে শিশু নিপীড়নের যে চিত্র উঠে এসেছে, তা বিচলিত হওয়ার মতো। গত বছর বাংলাদেশ থেকে শিশু যৌন নিপীড়ন-সংক্রান্ত ২৪ লাখ ৯১ হাজার ৩৬৮টি প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের অলাভজনক সংস্থা ন্যাশনাল সেন্টার ফর মিসিং অ্যান্ড এক্সপ্লয়টেড চিলড্রেনে (এনসিএমইসি)। বিশ্বের যেসব দেশ থেকে শিশুদের যৌন হয়রানি সম্পর্কে যত প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে, তার মধ্যে বাংলাদেশ শীর্ষে।

বিভিন্ন দেশ থেকে গত বছর মোট ৩ কোটি ২০ লাখ প্রতিবেদন এনসিএমইসিতে গেছে। বাংলাদেশের পরের অবস্থানে আছে যথাক্রমে যুক্তরাষ্ট্র, থাইল্যান্ড, নাইজেরিয়া, ফ্রান্স ও ডমিনিকান রিপাবলিক। গত বছর ইন্টারনেট ওয়াচ ফাউন্ডেশন ইন্টারনেট থেকে শিশুর যৌন নিপীড়ন ও হয়রানি-সংক্রান্ত ২ লাখ ৭৫ হাজার ৬৫২টি ইউআরএল অপসারণ করার জন্য কাজ করেছে।

ডিজিটাল যোগাযোগ শিশুদের অবাধে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও অনলাইন গেমের জগতে বিচরণের সুযোগ করে দিয়েছে। এখানে অপরাধীরা পরিচয় গোপন করে শিশু ভুক্তভোগীদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছেন। তাঁরা অনলাইনে শিশুদের আগ্রহ জেনে নেন এবং সংশ্লিষ্ট ছবি–ভিডিও ব্যবহার করে যৌন নিগ্রহের লক্ষ্যবস্তু করেন। সম্প্রতি অনলাইনে শিশু যৌন নির্যাতনের ঘটনা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে এআই প্রযুক্তির মাধ্যমে তৈরি করা বিভিন্ন ছবি ও ভিডিও।

এর আগে আইন ও সালিশ কেন্দ্র আরেকটি জরিপ করেছিল, যাতে দেখা যায় ছেলেশিশুদের চেয়ে মেয়েশিশুরা অনলাইনে বেশি নিগ্রহের শিকার হয়ে থাকে। অনলাইনে ৩৬ শতাংশের বেশি মেয়েশিশু বন্ধুদের দ্বারা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। ২৭ শতাংশের বেশি মেয়েশিশু পরিচিত প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি ও আত্মীয় এবং ১৮ শতাংশ অপরিচিত প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির মাধ্যমে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়।

শিশুদের এই যৌন নিগ্রহ থেকে রক্ষা করতে সবার আগে অভিভাবকদের এগিয়ে আসতে হবে। ইন্টারনেট ব্যবহারের বিপজ্জনক দিকগুলো সম্পর্কে শিশুদের সজাগ করতে হবে। ইউনিসেফের মতে, ১১ বছর বয়সের আগে শিশুদের ডিজিটাল দুনিয়ায় প্রবেশ করানো উচিত নয়। যদিও বাংলাদেশে ২৫ শতাংশ শিশু ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে থাকে। এ বিষয়ে অভিভাবকদের জন্য প্যারেন্টাল গাইড আছে, সেটা অনুসরণ করতে হবে। যথাসম্ভব শিশুদের বেশি সময় দিতে হবে, তাদের বেশি বেশি করে খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত করতে হবে।

অনলাইনে শিশুদের সুরক্ষিত রাখতে আইনের কার্যকর ব্যবহারের পাশাপাশি সব পর্যায়ে সচেতনতা বাড়াতে হবে। অভিভাবকদের শিশুদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে, যেন শিশুরা সবকিছু জানায়। শিশুরা যেন নিজেদের ছবি বা তথ্য অনলাইনে অন্য কাউকে না পাঠায়, তা নিয়ে শিশুদের বোঝানোর বিষয়ে মা-বাবাকে আরও সচেতন হতে হবে।

কেবল অভিভাবক নন, শিশুদের অনলাইনে নিগ্রহের হাত থেকে রক্ষা করতে এ রাষ্ট্র ও সমাজের সচেতন অংশেরও দায়িত্ব আছে। শিশুদের সুরক্ষায় জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯, চাইল্ড হেল্পলাইন ১০৯৮ এবং নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে ১০৯ নম্বরে কল করে সহায়তা চাওয়ার যে বিধান আছে, সেটা পুরোপুরি কাজে লাগাতে হবে। একই সঙ্গে অনলাইনে যারা শিশুদের নিগ্রহ করে থাকে, তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে।