২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে শুরু হওয়া রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের সঙ্গে কোনো রকম সংশ্লিষ্ট না থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশের ওপর বিরূপ প্রভাব অব্যাহত রয়েছে। পরাশক্তিগুলোর পাল্টাপাল্টি নিষেধাজ্ঞার কারণে বাংলাদেশে আমদানি পণ্যের দামই কেবল বাড়েনি, সরবরাহও ব্যাহত হয়েছে।
এরই মধ্যে ৭ জানুয়ারির নির্বাচন সামনে রেখে সরকার ও বিরোধী দলের মুখোমুখি অবস্থান দেশের রাজনীতিকে গভীর অনিশ্চয়তার মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টিসহ বেশ কিছু দল জোরেশোরে নির্বাচনী প্রক্রিয়া শুরু করলেও বিএনপি ও সমমনা দলগুলো নির্বাচনের তফসিল প্রত্যাখ্যানের পাশাপাশি সরকারের পদত্যাগের দাবিতে হরতাল-অবরোধ চালিয়ে যাচ্ছে। সপ্তম দফা অবরোধের পর বিএনপি আজ বুধবার অষ্টম দফা অবরোধ ও বৃহস্পতিবার আরেক দিনের হরতালের ডাক দিয়েছে।
নির্বাচন নিয়ে সরকার ও বিরোধী দল দীর্ঘদিন ধরেই বিপরীত মেরুতে অবস্থান করলেও জনজীবনে তার বিরূপ প্রভাব তেমন পড়েনি। দুই পক্ষই সভা-সমাবেশের মধ্যে তাদের কর্মসূচি সীমিত রেখেছিল। কিন্তু ২৮ অক্টোবরের পর সরকার যেমন নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে, তেমনি বিরোধী দলের কয়েক হাজার নেতা-কর্মী গ্রেপ্তারের শিকার হয়েছেন।
বিরোধী দলের হরতাল-অবরোধ সফল না বিফল, তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো জনজীবন ও অর্থনীতিতে এর বিরূপ প্রভাব। হরতাল-অবরোধের কারণে দূরপাল্লার বাস ছাড়ছে না। বিরোধী দলের কর্মসূচি কেন্দ্র করে প্রতিদিনই যানবাহনে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটছে। সাধারণ মানুষ ভয়ভীতির মধ্যে আছে। অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য পত্রিকান্তরে সাক্ষাৎকার দিয়ে বলেছেন, ‘অর্থনীতির আরেকটি সংকট হলো সরকারের আয় ও ব্যয় দুটিই কমে যাওয়া। ফলে সরকার উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ঠিকমতো বাস্তবায়ন করতে পারছে না। রাজস্ব ব্যয় করতেও টাকার সমস্যায় পড়ছে।’
নির্বাচনের তফসিল অনুযায়ী ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি ভোট হওয়ার কথা। নির্বাচনের দিন যত ঘনিয়ে আসবে, ততই পরিস্থিতি আরও তপ্ত হবে। এর প্রভাব-প্রতিক্রিয়া অর্থনীতিতেও পড়তে শুরু করেছে। এমনিতেই দেশের অর্থনীতি নাজুক অবস্থায়। ডলার-সংকট চলছে। বিনিয়োগ ও আমদানিতে ভাটা। বৈদেশিক ঋণের বোঝাও বাড়ছে। এ অবস্থায় রাজনৈতিক সংঘাত বাড়তে থাকলে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে মোড় নিতে পারে।
এ অবস্থায় সরকার ও প্রতিটি রাজনৈতিক দলের কাছে সহনশীল ও সংযত আচরণই প্রত্যাশিত। দেশের অর্থনৈতিক কাঠামো ভেঙে পড়ে, মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হয়—এমন কিছু করা কারও ঠিক হবে না। ২৮ অক্টোবরের পূর্বাবস্থায় দেশের রাজনীতিকে নিয়ে আসা যায় কি না, সেটা গুরুত্বের সঙ্গে ভাবা দরকার। এ ক্ষেত্রে যারা ক্ষমতায় আছে, তাদের দায়িত্বই বেশি। জনগণের জানমাল রক্ষার দায়িত্ব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর। এর অর্থ এই নয় যে বিরোধী দলের আন্দোলন মোকাবিলা করতে তারা যথেচ্ছ দমন–পীড়ন চালাবে।
একইভাবে বিরোধী দলকেও তাদের কর্মসূচির বিষয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। বিএনপির নেতারা বলেছেন, তাঁরা শান্তিপূর্ণভাবে হরতাল-অবরোধ পালন করছেন। কিন্তু তাঁদের কর্মসূচি কেন্দ্র করে যানবাহনে আগুন দেওয়ার যে ঘটনা ঘটছে, এর দায়ও তাঁরা এড়াতে পারেন না।
এসব ঘটনা যে-ই ঘটাক না কেন, তা জনগণের মধ্যে আতঙ্কের সৃষ্টি করে। বিরোধী দলকে বুঝতে হবে, আন্দোলন সফল করতে হয় জনগণকে সম্পৃক্ত করে, ভয় দেখিয়ে নয়।
দেশের অর্থনীতি নিয়ে যে উদ্বেগ ও অনিশ্চয়তা বিরাজ করছে, দেশের রাজনৈতিক পক্ষগুলো এর দায় এড়াতে পারে না। এ ধরনের পরিস্থিতির সবচেয়ে বড় শিকার হচ্ছে সাধারণ জনগণ। দেশ ও জনগণের কথা বিবেচনায় নিয়ে আমরা সব পক্ষের কাছ থেকে দায়িত্বশীল আচরণ প্রত্যাশা করছি। অর্থনীতির চাকা সচল রাখার বিকল্প নেই।