কিশোর গ্যাংয়ের টর্চার সেল

১৮ এপ্রিল প্রথম আলোর শেষ পাতায় প্রকাশিত নির্মাণাধীন সরকারি ভবনের ছবিটির বিশেষত্ব কী? আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে তো অনেক সরকারি ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে, অনেক ভবন সংস্কার হচ্ছে। কিন্তু সেসব ভবনের ছবি তো পত্রিকায় ছাপা হয় না। এই ছবি ছাপার বিশেষত্ব হলো স্থানীয় লোকজন এটিকে চেনেন ‘নিশান গ্রুপের (গোলাম রসুল ওরফে নিশান) টর্চার সেল’ নামে। 

এই টর্চার সেল অনেক আগে প্রতিষ্ঠিত হলেও সম্প্রতি আলোচনায় আসে কিশোর গ্যাংয়ের হাতে এক চিকিৎসকের মৃত্যুর ঘটনায়। ৫ এপ্রিল তাঁর কলেজপড়ুয়া ছেলে আলী রেজা ইফতারি কিনতে গেলে জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের নির্মাণাধীন ভবন থেকে ১৫ থেকে ২০ জন লাঠিসোঁটা নিয়ে হামলা চালায়। খবর পেয়ে সেখানে ছুটে যান চিকিৎসক বাবা। তিনি মাথায় গুরুতর আঘাত পান এবং চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় ১০ এপ্রিল মারা যান। কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের কর্মকাণ্ডের বিষয়টি আলী রেজা পুলিশকে জানিয়ে দেন বলেই তাঁর ওপর আক্রোশ ছিল নিশান গ্রুপের। 

এই কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা স্থানীয় যুবলীগ নেতা গোলাম রসুলের অনুসারী। এই ঘটনায় গোলাম রসুলসহ ১২ জনের নাম উল্লেখ করে থানায় হত্যা মামলা হয়েছিল। কিন্তু ধরা পড়েছে মাত্র ৩ জন। গ্যাংয়ের নেতা গোলাম রসুলসহ বাকিরা ধরাছোঁয়ার বাইরেই আছেন। 

গোলাম রসুলের এই ক্ষমতার উৎস কী? উৎস হলো তিনি ছাত্রলীগের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাবেক সহসভাপতি এবং চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র আজম নাছিরের অনুসারী। গোলাম রসুলের বিরুদ্ধে হত্যা, চাঁদাবাজি, মারামারির সাতটি মামলা রয়েছে। 

পুলিশ জানায়, চট্টগ্রাম নগরে অন্তত ২০০ কিশোর গ্যাং সক্রিয় রয়েছে। একেক দলে রয়েছে ৫ থেকে ১৫ জন। পুলিশের হিসাবে নগরজুড়ে এসব গ্যাংয়ের সদস্যসংখ্যা অন্তত ১ হাজার ৪০০। পুলিশ বলছে, কিশোর গ্যাংয়ের পৃষ্ঠপোষকতা বা প্রশ্রয় দিচ্ছেন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ৫ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলরসহ ৬৪ জন ‘বড় ভাই’। গত ছয় বছরে ৫৪৮টি অপরাধের ঘটনায় কিশোর গ্যাং জড়িত বলে জানায় পুলিশ। এর মধ্যে খুনের ঘটনা ঘটেছে ৩৪টি। 

সম্প্রতি আইনশৃঙ্খলা রক্ষা কমিটির বৈঠকেও জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামানও স্বীকার করেছেন, কিশোর গ্যাংয়ের হাত থেকে নিরীহ মানুষ, চিকিৎসক, ব্যবসায়ী, শিক্ষক থেকে শুরু করে কেউ রক্ষা পাচ্ছেন না। তিনি শুধু কিশোর গ্যাং নয়, তাদের গডফাদারদেরও (মদদদাতা) আইনের আওতায় আনার কথা বলেছেন। একটি শহরে ২০০ কিশোর গ্যাং গড়ে উঠল অথচ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তেমন তৎপরতা লক্ষ করা যাচ্ছে না। কোথাও অঘটন ঘটলে তারা নড়েচড়ে বসে। 

কেবল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নয়, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদেরও এ বিষয়ে দায়িত্ব থাকার কথা। কিন্তু তঁারা দায়িত্ব পালন করবেন কি? অনেক স্থানীয় জনপ্রতিনিধি কিংবা কাউন্সিলরের বিরুদ্ধেই যখন কিশোর গ্যাংকে পৃষ্ঠপোষকতার অভিযোগ ওঠে, তখন তঁাদের কাছ থেকে কী আশা করা যায়? 

স্থানীয় বাসিন্দারা ভয়ে কিছু বলতে পারেন না। অনেক অভিভাবক সন্তানকে স্কুলে পাঠাতেও ভয় পাচ্ছেন। ইতিমধ্যে কিশোর গ্যাংয়ের হাতে নিহত চিকিৎসকের সন্তান আলী রেজাকে ভয়ভীতি দেখানো হচ্ছে। আলী রেজা এ বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে নিরাপত্তাও দাবি করেছেন। অথচ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কিশোর গ্যাংয়ের হোতাদের খুঁজে পাচ্ছে না; এটা অবিশ্বাস্য। নিশান গ্রুপের হাতে ইতিমধ্যে দুজন মানুষকে জীবন দিতে হয়েছে। আর কত জীবন ঝরে গেলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চৈতন্যোদয় হবে?