সাধারণত সরকার পরিবর্তনের পর শেয়ারবাজারে চাঙাভাব দেখা দেয়। কিন্তু সম্প্রতি ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ শাসনের বিদায় ও অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার পর গত আড়াই মাসে ক্রমাগত দরপতন ঘটায় বিনিয়োগকারীদের মধ্যে একধরনের আতঙ্ক তৈরি করেছে।
‘আস্থা পাচ্ছেন না বিনিয়োগকারীরা’ শিরোনামে প্রথম আলোয় প্রতিবেদন প্রকাশের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে নতুন দুঃসংবাদ এল সপ্তাহের শেষ কার্যদিবস বৃহস্পতিবারও দেশের দুই স্টক এক্সচেঞ্জে বড় ধরনের দরপতনের।
প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান সূচক ডিএসইএক্স এদিন ৫৫ পয়েন্ট বা ১ শতাংশ কমে নেমে এসেছে ৫ হাজার ১১৪ পয়েন্টে। গত প্রায় সাড়ে চার মাসের মধ্যে এটিই ডিএসইএক্সের সর্বনিম্ন অবস্থান। এর আগে সর্বশেষ গত ১২ জুন ডিএসইএক্স সূচকটি ৫ হাজার ৮৩ পয়েন্টের সর্বনিম্ন অবস্থানে ছিল। অপর শেয়ারবাজার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) সার্বিক সূচকটিও বৃহস্পতিবার ২০০ পয়েন্ট বা সোয়া ১ শতাংশের বেশি কমেছে।
শেয়ারবাজারের শীর্ষস্থানীয় ব্রোকারেজ হাউস লংকাবাংলা সিকিউরিটিজের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বৃহস্পতিবারের বড় ধরনের দরপতনের পেছনে বড় ভূমিকা ছিল স্কয়ার ফার্মা, ইসলামী ব্যাংক, ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশ কোম্পানি বা বিএটিবিসি, গ্রামীণফোন ও রেনাটার। এই পাঁচ কোম্পানির শেয়ারের বাজারমূল্য কমায় সম্মিলিতভাবে ডিএসইএক্স সূচকটি কমেছে ৪১ পয়েন্ট।
টানা দরপতনের কারণে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আস্থাহীনতায় ভুগছেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। পাশাপাশি প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরাও অনেকটা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছেন। ফলে বাজারে ক্রেতার সংকট দেখা দিয়েছে। অন্যদিকে ঋণগ্রস্ত বিনিয়োগকারীদের একটি বড় অংশের শেয়ার জোরপূর্বক বিক্রি বা ফোর্সড সেলের আওতায় পড়ছে। বাজার যত নিচে নামছে, ফোর্সড সেলের চাপও তত বাড়ছে।
বাজারে ক্রেতার চেয়ে বিক্রেতা বেশি হওয়ায় দরপতনের পাশাপাশি লেনদেনের পরিমাণও কমছে। ঢাকার বাজারে বৃহস্পতিবার লেনদেনের পরিমাণ ছিল ৩০৬ কোটি টাকা, যা আগের দিনের চেয়ে ১৬ কোটি টাকা কম। নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম বাজার ঘুরে দাঁড়াবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করলেও বাস্তবতা তার বিপরীত। সংকট উত্তরণে তাঁদের কোনো পদক্ষেপের কথাও জানা যায় না।
বিও (বেনিফিশিয়ারি ওনার্স) হিসাব সংরক্ষণকারী প্রতিষ্ঠান সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি বাংলাদেশ লিমিটেড বা সিডিবিএলের তথ্য অনুযায়ী, চলতি মাসের প্রথম ১৪ কার্যদিবসে সাড়ে ৬ হাজার বিনিয়োগকারী তাঁদের বিও হিসাবে থাকা সব শেয়ার বিক্রি করে দিয়েছেন। ফলে এসব বিও হিসাব এখন শেয়ারশূন্য বিও হিসাবে পরিণত হয়েছে।
শেয়ারবাজার এখন দ্বিমুখী সংকটের মুখে। একদিকে বিদ্যমান বিনিয়োগকারীদের একটি অংশ নিষ্ক্রিয়; অন্যদিকে নতুন বিনিয়োগকারীও খুব বেশি আসছেন না। বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী প্রথম আলোকে বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে আমাদের বাজারে নানা ধরনের অনিয়ম চলে আসছে। তাই বাজারে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু রাতারাতি ও এককভাবে কারও পক্ষে বাজার থেকে সব অনিয়ম দূর করা কঠিন কাজ। এই কঠিন কাজই করতে হবে বাজার–সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে আস্থায় নিয়ে, ধীরে ধীরে।’
প্রশ্ন হলো কাজটি করবে কে এবং কীভাবে। শেয়ারবাজার এত দিন চলে আসছিল তুঘলকি কায়দায়। কতিপয় বড় প্রতিষ্ঠানকে অন্যায় সুবিধা দেওয়ার জন্য নীতিকৌশল ঠিক করা হতো। এতে তারা লাভবান হলেও সাধারণ বিনিয়োগকারীদের সর্বনাশ হয়েছে। এই অবস্থার পরিবর্তন তথা বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনতে বাস্তবমুখী নীতি ও পরিকল্পনা নিতে হবে। অনিয়ম ও কারসাজি বন্ধ করতে হবে। ইতিমধ্যে যাঁরা শেয়ারবাজার থেকে কারসাজি করে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাজার হাজার কোটি টাকা লুট করেছেন, তাঁদের আইনের আওতায় আনতে হবে।