ভুলভ্রান্তিগুলো চিহ্নিত করা জরুরি

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে দেশবাসীর প্রতি তাঁর শাসনামলের ভুলভ্রান্তি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখার আবেদন রেখেছেন। এই ভাষণে তিনি পরপর তিনবার আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়ে ক্ষমতায় আনার জন্য দেশবাসীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের পাশাপাশি চতুর্থবার নৌকায় ভোট দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। এখানে উল্লেখ্য যে ১৯৯৬ সালের নির্বাচনের আগেও শেখ হাসিনা অতীতের ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখার কথা বলেছিলেন। 

বিএনপি ও সমমনা দলগুলো এবারের নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে না। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে এই দলগুলোকে বাদ দিয়েই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলগুলোর অনুপস্থিতির কারণে দেশের জনগণের মধ্যে এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জয়ের ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। দ্য ইকোনমিস্টসহ অনেক বিদেশি সংবাদমাধ্যমও ভবিষ্যদ্বাণী করেছে, শেখ হাসিনার নেতৃত্বেই বাংলাদেশে নতুন সরকার গঠিত হতে যাচ্ছে। 

প্রধানমন্ত্রী জনগণের প্রতি তাঁর শাসনামলের ভুলভ্রান্তিগুলো ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখার আবেদন রেখেছেন, তবে ভুলভ্রান্তিগুলো কী, তা পরিষ্কার করেননি। তিনি বলেছেন, ‘চলার পথে যদি কোনো ভুলভ্রান্তি করে থাকি, তাহলে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন—এটাই আমার আবেদন।’ এমন পরিস্থিতিতে জনগণ স্বাভাবিকভাবেই গত ১৫ বছর কিংবা আরও নির্দিষ্ট করে বললে, গত পাঁচ বছরে সরকারের সাফল্য-ব্যর্থতা মূল্যায়ন করতে চাইবে। ভুলভ্রান্তিগুলো কী, তা খোঁজার চেষ্টা করবে। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর আর্থসামাজিক ও অবকাঠামোগত ক্ষেত্রে নানা উন্নয়ন হয়েছে। পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, কর্ণফুলী টানেলসহ বড় বড় স্থাপনা নির্মিত হয়েছে। এই সময়ে শিক্ষার হার বেড়েছে, ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছানো গেছে, মানুষের গড় আয় ও আয়ু বেড়েছে। এগুলো নিঃসন্দেহে সরকারের সাফল্য। 

কিন্তু সুশাসনের অভাব, দুর্নীতির রাশ টানতে না পারা, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম সাধারণ মানুষের নাগালে রাখতে না পারা, ব্যাংকিং খাতে বিশৃঙ্খলা ও খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে যাওয়া এবং বিদেশে অর্থ পাচার সরকারের দুর্বল শাসনকাঠামোর লক্ষণ। গত ১৫ বছরে দারিদ্র্যের হার কমলেও বৈষম্য বেড়েছে অনেক বেশি। ফলে মুষ্টিমেয় গোষ্ঠীর হাতে সম্পদ পুঞ্জীভূত হচ্ছে, আর দিনযাপনের গ্লানি বয়ে চলেছে কোটি কোটি মানুষ। এ সময়ে দেশে গণতন্ত্র ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার পরিসর সংকুচিত হয়েছে, মানবাধিকার পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। 

২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে দুর্নীতি, মাদক ও জঙ্গিবাদের প্রতি শূন্য সহিষ্ণুতা দেখানোর কথা বলা হয়েছিল। এরপর টানা ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকলেও জঙ্গিবাদের ক্ষেত্রে সাফল্য ছাড়া বাকি দুটি ক্ষেত্রে পরিস্থিতি বরং খারাপ হয়েছে। এই দুটি ক্ষেত্রে কেন সাফল্য পাওয়া গেল না, দল ও সরকারের তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। 

আওয়ামী লীগ সভাপতি ব্যাংক-বিমা ও আর্থিক খাতের দক্ষতা ও সক্ষমতা বৃদ্ধি করা; আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাগুলোর জবাবদিহি নিশ্চিত করার কথা বলেছেন। এর অর্থ এসব খাতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির ঘাটতি রয়ে গেছে। অন্যদিকে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ শতাংশে হিসাব করে এই সংকটের সমাধান পাওয়া যাবে না। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে নগদ টাকা দিয়ে টিকিয়ে রাখা সুস্থতার লক্ষণ নয়। যাদের চুরি-দুর্নীতির কারণে আর্থিক খাত বেহাল, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিলে উত্তরণের সম্ভাবনা কম। জনগণ যদি দেখতে পেত দুর্নীতিবাজ ও পাচারকারীদের বিরুদ্ধে সরকার শক্ত পদক্ষেপ নিয়েছে, তাহলে তারা আশ্বস্ত হতে পারত। 

আওয়ামী লীগ সভাপতি সর্বস্তরে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সুরক্ষা ও চর্চার প্রসারের করার কথা বলেছেন। সেটা তখনই সম্ভব, যখন সেই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও চর্চার সুফল দলমত-নির্বিশেষে সব মানুষ পাবে। গত ১৫ বছরে সেই চর্চা কতটুকু হয়েছে, তা বিচার-বিবেচনা করার সক্ষমতা জনগণের রয়েছে। আমরা আশা করব, দল হিসেবে আওয়ামী লীগ নিজেই তাদের ভুলভ্রান্তিগুলো চিহ্নিত করার চেষ্টা করবে এবং সেগুলো দূর করার কার্যকর পথ ধরবে। জনগণ সেটাই প্রত্যাশা করে।