‘লঘুদণ্ড’ মাদক ব্যবসাকে উৎসাহিত করবে

সম্পাদকীয়

আত্মস্বীকৃত ১০১ জন ইয়াবা কারবারিকে দেড় বছর করে কারাদণ্ড দেওয়ার ঘটনাটি গুরু পাপে লঘুদণ্ড হিসেবে চিহ্নিত হবে। সর্বনাশা মাদক ব্যবসার সঙ্গে যাঁরা জড়িত, তঁাদের এ দণ্ড মাদক ব্যবসাকেই উৎসাহিত করবে। তাঁরা যদি সত্যি সত্যি ইয়াবা কারবারি হয়ে থাকেন, তাঁদের শাস্তি অনেক বেশি হওয়ার কথা।

আর যদি তঁারা অপরাধী না হয়ে থাকেন, গুরু বা লঘু কোনো দণ্ডই তঁাদের খাটার কথা নয়। বুধবার এ রায় ঘোষণা করেন কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইল। ১০১ আসামির মধ্যে ১৮ জন আদালতে উপস্থিত ছিলেন, বাকিরা পলাতক।

প্রথম আলোর খবর থেকে জানা যায়, ২০১৯ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি সকাল ১০টায় টেকনাফ পাইলট স্কুল মাঠে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও পুলিশের মহাপরিদর্শকের উপস্থিতিতে ১০২ ইয়াবা কারবারি ও পৃষ্ঠপোষক ৩০টি দেশি বন্দুক, ৭০টি গুলি ও ৩ লাখ ৫০ হাজার ইয়াবা বড়ি জমা দিয়ে আত্মসমর্পণ করেন। এই আত্মসমর্পণকারীদের মধ্যে টেকনাফের সাবেক সংসদ সদস্য আবদুর রহমান ওরফে বদির চার ভাইসহ ১২ নিকটাত্মীয়ও আছেন। বদির ভাই ও নিকটাত্মীয়রা ইয়াবা ব্যবসায়ী ও পৃষ্ঠপোষক হিসেবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত।

গুরু পাপে এ লঘুদণ্ড নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। অপরাধীদের শাস্তি দেওয়া হয় অপরাধ দমন বা নিয়ন্ত্রণের আনার জন্য। কিন্তু যঁারা ইয়াবা ব্যবসা করে কোটি কোটি টাকা কামিয়েছেন, লাখ লাখ মানুষের জীবন ও পরিবার ধ্বংস করেছেন, তাঁদের শাস্তি মাত্র দেড় বছর জেল ও ২০ হাজার টাকা জরিমানা!

ইতিমধ্যে কক্সবাজার সিভিল সোসাইটিজ ফোরামের সভাপতি ফজলুল কাদের চৌধুরী রায়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেছেন, ইয়াবা ব্যবসায়ীদের সর্বোচ্চ শাস্তি হওয়া উচিত ছিল। লঘুদণ্ড দিয়ে ইয়াবা ব্যবসায়ীদের উৎসাহিত করা হলো। অথচ ২০১৮ সালের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মাদক ব্যবসার সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড।

অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনে যে মামলা হয়, তাতে সবাই বেকসুর খালাস পেয়ে গেছেন। পুলিশের ভাষ্য অনুযায়ী, অস্ত্রসহ যদি আসামিরা আত্মসমর্পণ করে থাকেন, তাহলে অস্ত্র আইনে তাঁরা বেকসুর খালাস পেলেন কীভাবে? এর পেছনে রহস্য কী? ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে কক্সবাজারসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বহু মানুষ কথিত বন্দুকযুদ্ধের শিকার হয়েছেন। সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সিনহা মো. রাশেদ খান কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়ার পর সেই প্রক্রিয়া অনেকটা থেমে যায়। আমরা কোনো অবস্থায়ই বিচারবহির্ভূত হত্যাকে সমর্থন করি না।

কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে আইনের মারপ্যাঁচে ইয়াবা কারবারিদের লঘুদণ্ড দিয়ে রক্ষা করা হবে। মামলার বিচার বা শাস্তি হয় মামলার গুণাগুণ ও সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে। তাহলে কি উপযুক্ত শাস্তি পাওয়ার মতো তথ্যপ্রমাণ হাজির করা হয়নি? অভিযোগ আছে, ২০১৯ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারির আত্মসমর্পণের অনুষ্ঠানটি ছিল সাজানো।

পুলিশ আসামিদের আগেই আটক করে রেখেছিল। তাহলে কি প্রভাবশালী মাদক ব্যবসায়ী ও পৃষ্ঠপোষকদের রক্ষা করতেই এ আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান সাজানো হয়েছিল? সরকারের নীতিনির্ধারকেরা যদি এ ধরনের ঘটনার প্রশ্রয় দিয়ে থাকেন, তাহলে সমাজে মাদকের ভয়ংকর ছোবল চলতেই থাকবে।

কক্সবাজারের টেকনাফের ১০১ ইয়াবা ব্যবসায়ীর মামলাটি পুনঃ তদন্ত ও পুনর্বিচার করা হোক ন্যায়বিচারের স্বার্থে। কতিপয় ব্যবসায়ীকে রক্ষা করতে গিয়ে বাংলাদেশ মাদকসেবী ও মাদক ব্যবসায়ীদের স্বর্গ হতে পারে না।