অর্থ পাচার বন্ধে রাজনৈতিক অঙ্গীকার জরুরি

সম্পাদকীয়

দেশের অর্থ বিদেশে পাচার নিয়ে সরগরম আলোচনা চলে আসছে বেশ কয়েক বছর ধরে। সরকার অর্থ পাচারের বিরুদ্ধে শূন্য সহিষ্ণুতা দেখানোর জোর আওয়াজ তোলে। তবে সেই আওয়াজ দলের নির্বাচনী ইশতেহার কিংবা মঞ্চে নেতা-নেত্রীদের বক্তৃতায় সীমিত। অর্থ পাচার বন্ধে কার্যকর ও টেকসই কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায় না।

দেশের আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রতিবেদনে দেখা যায়, আর্থিক খাতে সন্দেহজনক লেনদেন সার্বিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে, আগের অর্থবছরের তুলনায় যা প্রায় ৬৫ শতাংশ বেড়েছে।

বিএফআইইউর প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে তাদের কাছে পাঠানো ঋণসংক্রান্ত সন্দেহজনক লেনদেন প্রতিবেদনের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫২০, যা এর আগের ২০২১-২২ অর্থবছরে ছিল ৩৪১টি। গত অর্থবছরে ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, বিমা, ব্রোকারেজ হাউসসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বিএফআইইউতে সব মিলিয়ে সন্দেহজনক লেনদেন প্রতিবেদন পাঠিয়েছিল ১৪ হাজার ১০৬টি, যা ২০২১-২২ অর্থবছরে ছিল ৮ হাজার ৫৭১টি।

বিএফআইইউ অর্থ পাচার রোধে দেশের বিভিন্ন সংস্থার সমন্বয়ক ইউনিট হিসেবে কাজ করে। ব্যাংক কর্মকর্তারা যেসব লেনদেনকে সন্দেহজনক বলে মনে করেন, সেসব লেনদেনকে তাঁরা ‘সন্দেহজনক লেনদেন প্রতিবেদন’ হিসেবে বিএফআইইউতে পাঠিয়ে দেন। কোনো ছোট গ্রাহকের হিসাবে বড় লেনদেন, কোনো গ্রাহকের একসঙ্গে বড় অঙ্কের নগদ অর্থ উত্তোলন, ছোট ব্যবসায়ীর নামে বড় ঋণ, অপরিচিত হিসাবে টাকা স্থানান্তর, সম্পর্ক নেই এমন হিসাবে লেনদেন—ব্যাংকগুলো সাধারণত এসব বিষয়কে সন্দেহজনক লেনদেন হিসেবে বিবেচনা করে।

পাচার বন্ধে বিএফআইইউ কী করছে—সাংবাদিকদের এ রকম প্রশ্নের উত্তরে বিএফআইইউর প্রধান কর্মকর্তা মো. মাসুদ বিশ্বাস বলেন, পাচার করা অর্থ ফিরিয়ে আনতে শক্ত রাজনৈতিক সদিচ্ছা দরকার। আওয়ামী সরকার ক্ষমতায় এসে বিএনপি সরকারের আমলে পাচার হওয়া কিছু অর্থ ফেরত এনে কৃতিত্ব জাহির করেছিল। সেটা প্রশংসিতও হয়েছিল। কিন্তু গত ১৫ বছরে এই সরকারের আমলে যে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হলো, সেটা বন্ধে কিংবা পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনতে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি।

আর্থিকসহ সব ধরনের অপরাধ লুকানো, কর ফাঁকি, বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় হার আইন ও বিনিয়োগ নীতি লঙ্ঘন, অন্য দেশে নিরাপদ বিনিয়োগ এবং উন্নত দেশের উঁচু মানের জীবনযাত্রার লোভে সেখানকার নাগরিকত্ব লাভ—এসব উদ্দেশ্যে অর্থ পাচার হয়ে থাকে। রাষ্ট্রের দায়িত্ব পাচার বন্ধ করা এবং পাচারকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া।

দুর্নীতি ও অনিয়মের মাধ্যমে অর্জিত অর্থই সাধারণত বিদেশে পাচার করা হয়। আবার দেশে বিনিয়োগের পরিবেশ নেই বলেও অনেক উদ্যোক্তা বিদেশে অর্থ পাচার করে থাকেন। বছর দুই আগে বাজেটে পাচার হওয়া অর্থ নির্দিষ্ট পরিমাণ জরিমানা দিয়ে দেশে ফেরত আনার সুযোগ দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। একটি টাকাও ফেরত আসেনি। আরেক পরিসংখ্যানে জানা গেছে, দেশ থেকে বিদেশে যে অর্থ পাচার হয়, তার সিংহভাগ হয় আমদানি-রপ্তানিতে ওভারভয়েস ও আন্ডারভয়েস দেখিয়ে। 

বিদেশে অর্থ পাচার রোধ করতে হলে দুর্নীতির লাগামটি টেনে ধরতে হবে। আর্থিক লেনদেনের ক্ষেত্রে শতভাগ স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ মুস্তফা কে মুজেরী পাচার বন্ধে সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে প্রকৃত রাজনৈতিক অঙ্গীকারের ওপর জোর দিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে কারও প্রতি ছাড় দেওয়া কিংবা পক্ষপাত দেখানো হলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে।

পাচারের ক্ষেত্রে জনমনে এই ধারণা আছে যে সরকার চুনোপুঁটিদের ধরলেও রাঘববোয়ালেরা ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাচ্ছেন। সরকার যদি সত্যি সত্যি পাচার বন্ধ করতে চায়, রাঘববোয়ালদের আইনের আওতায় আনতে হবে।