রাজশাহী অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর দ্রুত নেমে যাওয়ার কারণ সেচপাম্পের মাধ্যমে বেশি পরিমাণে পানি উত্তোলন। এই প্রেক্ষাপটে বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিএমডিএ) ২০১৫ সাল থেকে নতুন করে গভীর নলকূপ না বসানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিন্তু গত আট বছরে অনেকেই সেই সিদ্ধান্ত না মেনে যথেচ্ছ সেচপাম্প বসিয়ে পানি তুলে নিচ্ছেন।
প্রথম আলোর খবরে জানা যায়, বরেন্দ্র অঞ্চলে এএমডিএর ১৭ হাজারের বেশি গভীর নলকূপ চালু আছে। শুধু রাজশাহী জেলায় প্রায় ২ হাজার ৮০০ গভীর নলকূপ চলমান। আছে ব্যক্তিমালিকানাধীন অনেক নলকূপ। পানির স্তর নেমে যাওয়ায় বিএমডিএ সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, নতুন করে কেউ নলকূপ বসাতে চাইলে উপজেলা সেচ কমিটির অনুমোদন নিতে হবে। ওই কমিটির প্রধান উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও সদস্যসচিব বিএমডিএর স্থানীয় সহকারী প্রকৌশলী।
আরও অনেক সরকারি প্রতিষ্ঠানের মতো বিএমডিএর সিদ্ধান্তও কার্যকর হচ্ছে না। অনেকে রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে বা কৌশলে মুরগির খামার, সবজি চাষ বা আবাসিক বিদ্যুৎ-সংযোগ নিয়ে ভূসেচপাম্প চালু রেখেছেন। শুধু তানোর উপজেলায়ই অনুমোদনহীন প্রায় আড়াই হাজার সেচপাম্প রয়েছে।
পল্লী বিদ্যুৎ তানোর আঞ্চলিক কার্যালয়ের উপমহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) জহুরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, জমিতে ধান থাকায় মানবিক কারণে তাঁরা সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে পারেননি। কেউ আবাসিক বা মুরগির খামারের মিটার থেকে সংযোগ নিয়ে সেচ দিলে তাঁদের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হবে—এই মর্মে গত মে থেকে তাঁরা বিদ্যুৎ বিলের কাগজে সিল মেরে দিচ্ছেন। কিন্তু বিদ্যুৎ–সংযোগ বিচ্ছিন্ন করলেই যে সমস্যার সমাধান হবে, তা নয়। বিকল্প ব্যবস্থাও রাখতে হবে।
পানির স্তর নেমে যাচ্ছে, এটি যেমন উদ্বেগজনক খবর, তেমনি পানির অভাবে কৃষকের জমি বিরান পড়ে থাকবে, তা–ও হতে পারে না। সেচের জন্য প্রয়োজনীয় পানিও কৃষককে পেতে হবে। এ জন্য বিকল্প উপায় খুঁজতে হবে। কৃষিবিজ্ঞানীরা মনে করেন, ধান উৎপাদনে সাশ্রয়ী প্রযুক্তি ব্যবহার করলে ২৮ শতাংশ পর্যন্ত কম পানি ব্যবহৃত হবে। দ্বিতীয়ত, এ অঞ্চলে যেসব পুকুর, নালা, বিল ও নদী আছে, সেখান থেকে যথাসম্ভব সেচের পানি ব্যবহার করতে হবে। এর পাশাপাশি বৃষ্টির পানি মজুত রেখেও শুকনা মৌসুমে পানির চাহিদা মেটানো যায়।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক চৌধুরী সারওয়ার জাহান প্রথম আলোকে বলেন, যেভাবে পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে, তাতে বরেন্দ্র এলাকায় বহুমুখী সংকট তৈরি হবে, জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়বে এবং কৃষি উৎপাদনও ব্যাহত হবে। পদ্মা থেকে পানি এনে উত্তর রাজশাহী সেচ প্রকল্পে পদ্মা থেকে পানি এনে চাহিদা মেটানোর দাবি দীর্ঘদিনের। প্রস্তাবটি একাধিকবার একনেকে উঠলেও অনুমোদন না পাওয়া দুর্ভাগ্যজনক। বরেন্দ্র অঞ্চলের কৃষকদেরও বাঁচাতে হবে। একই সঙ্গে পানির স্তর যাতে নিচে না নামে, সেটাও নিশ্চিত করতে হবে। পানির স্তর ক্রমাগত নিচে নামতে থাকলে একসময়ে গভীর নলকূপ বসিয়েও লাভ হবে না।
বিএমডিএর সিদ্ধান্ত অগ্রাহ্য করে অন্য প্রকল্পের নামে যাতে কেউ সেচের জন্য বিদ্যুৎ–সংযোগ নিতে না পারে, সে বিষয়েও কর্তৃপক্ষকে কঠোর অবস্থান নিতে হবে। রাজনৈতিক প্রভাবের কাছে নতিস্বীকার করা যাবে না।