মশা নিয়ন্ত্রণ কি অসম্ভব কিছু

সম্পাদকীয়

সাধারণত এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর মাসে বাংলাদেশে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব ঘটে।  উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, এ বছর অক্টোবরের শেষ ভাগে এসেও ডেঙ্গুর সংক্রমণ কমার কোনো লক্ষণ নেই। বরং কয়েক দিন ধরে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বেড়েই চলেছে।

চলতি বছর এ পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মারা গেছেন ১০৬ জন, যা দেশের ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। অবস্থা বেগতিক দেখে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ঢাকা, কক্সবাজার, যশোর ও পাবনা জেলার সরকারি হাসপাতালে ডেঙ্গু ইউনিট খোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব মুহাম্মদ আনোয়ার হোসেনও স্বীকার করেছেন, ‘ঢাকা মেডিকেল, সোহরাওয়ার্দী ও বিশেষায়িত হাসপাতালগুলোর কোনোটিতেই শয্যা খালি নেই। কিন্তু আমরা রোগীদের ফেরত পাঠাতে পারি না।

যেভাবেই হোক চিকিৎসা দিচ্ছি।’ গত ১৭ সেপ্টেম্বর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণবিষয়ক অবহিতকরণ ও মতবিনিময় সভায় বেশি আক্রান্ত এলাকার সরকারি হাসপাতালে আলাদা ডেঙ্গু ইউনিট চালুর সিদ্ধান্ত হয়েছে। ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসার জন্য পর্যাপ্ত ফ্লুইড সরবরাহ করা, প্রয়োজনে প্রতিটি ওয়ার্ডে মশারি ব্যবহার বাধ্যতামূলক করার কথাও বলেছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা।

ডেঙ্গু এমন রোগ নয় যে এটি প্রতিরোধ করা যায় না। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর যা করেছে, সেটি হলো আক্রান্ত হওয়ার পর রোগীর চিকিৎসা নিশ্চিত করা। কিন্তু আমরা ডেঙ্গু রোগের উৎস এডিস মশার জন্ম ঠেকাতে পারলাম না কেন?

ঢাকা বা অন্যান্য শহরের যেসব জায়গায় এডিস মশার জন্ম, সেসব জায়গা পরিচ্ছন্ন রাখতে পারলে, পানি জমতে না দিলে কিন্তু ডেঙ্গু সহজেই প্রতিরোধ করা যেত। স্বাস্থ্যসচিব বলেন, ‘সাধারণ মানুষ যদি সচেতন না হয়, তাহলে আমরা অভিযান পরিচালনা করেও কিছু করতে পারব না।’

আমরাও মনে করি, এ বিষয়ে জনগণের সচেতনতার ঘাটতি আছে। কিন্তু যাঁরা তাদের সচেতন করবেন কিংবা যাঁদের তদারক করার কথা, তাঁরা কী করেছেন? বাড়িঘর কেন, অনেক সরকারি অফিসেই ময়লা-আবর্জনা পানির টবে ও ছাদে পানি জমে থাকে।

সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ চলার সময়ও পানি ও ময়লা আবর্জনা জমে থাকে; যা থেকে এডিসের বংশবিস্তার ঘটে। আবার আক্রান্ত ব্যক্তিদের মশারির মধ্যে না রাখায় ডেঙ্গুর বিস্তার অনেক বেড়ে যাচ্ছে। আইসিডিডিআরবির করা এক গবেষণায় দেখা গেছে, চিকিৎসাধীন ২৫ ভাগ ডেঙ্গু রোগী মশারি ব্যবহার করছেন না।

বাংলায় একটি কথা চালু আছে, ‘আপনি আচরি ধর্ম’—আগে নিজে সচেতন হোন, তারপর অন্যদের সচেতন করুন। সিটি করপোরেশন বা পৌরসভাগুলো বিক্ষিপ্ত ও বিচ্ছিন্নভাবে কিছু পদক্ষেপ নিয়ে থাকে; সাময়িক কিছু ফলও হয়তো পাওয়া যায়। তারপর সংক্রমণ আগের অবস্থায় ফিরে আসে।

এমনকি সিটি করপোরেশন মশা মারতে যে ওষুধ ছিটিয়ে থাকে, তার কার্যকারিতা নিয়েও প্রশ্ন আছে। বহু বছর আগে হাবীবুল্লাহ বাহার যখন পূর্ব পাকিস্তানের স্বাস্থ্যমন্ত্রী ছিলেন, তখন তিনি এই ঢাকা শহরে মশার বংশ ধ্বংস করেছিলেন, যা আজও প্রবাদ হয়ে আছে।

সে সময় প্রযুক্তিও এত উন্নত ছিল না। তারপরও হাবীবুল্লাহ বাহার ঢাকা শহরকে মশকমুক্ত করেছিলেন। আজ উন্নত প্রযুক্তি ও প্রতিষেধক থাকা সত্ত্বেও সিটি করপোরেশন পারছে না কেন? এর কারণ, যাঁরা মশকনিধন কিংবা ডেঙ্গু প্রতিরোধের দায়িত্বে নিয়োজিত, তাঁদের সদিচ্ছা ও দক্ষতা দুটোরই অভাব আছে।

রোগী মারা যাওয়ার পর ডাক্তার ডাকার কোনো দরকার নেই। রোগী বেঁচে থাকতেই ডাক্তার ডাকতে হবে। অর্থাৎ ডেঙ্গু রোগের চিকিৎসার চেয়ে জরুরি হলো ডেঙ্গুর উৎস নির্মূল করা। সেটি করতে পারলে হাসপাতালে রোগীদের নিয়ে এত পেরেশান হতে হবে না, সিটি করপোরেশনকেও মশা মারতে কামান দাগতে হবে না।