কোটা সংস্কারে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ও পরবর্তী সংঘর্ষ-সহিংস পরিস্থিতিতে দেশে যে অচলাবস্থা তৈরি হয়, সেটি আরও গভীর মাত্রা পেয়েছে ইন্টারনেট বন্ধ থাকায়। একটি দেশে যে টানা ১০ দিন ইন্টারনেট সংযোগ পুরোপুরি বন্ধ থাকল, তা এ সময় গোটা বিশ্বে একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হয়ে থাকল।
সরকার চাপের মুখে ইন্টারনেট চালু করলেও তা এখনো নামকাওয়াস্তে। যে ধীরগতিতে এখন ইন্টারনেট চলছে, তা অনলাইনকেন্দ্রিক সব ধরনের কাজকেই বাধাগ্রস্ত করছে। মানুষের সব ধরনের কার্যক্রমই যেখানে ইন্টারনেটনির্ভর, সেখানে এভাবে ইন্টারনেট সংযোগকে ধীরগতির করে রাখার কোনো মানে হয় না।
ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট বন্ধ করার পর ইন্টারনেট–সেবাদাতাদের বিভিন্ন সরঞ্জাম স্থাপন করা রাজধানীর একটি ভবনে আগুন দেওয়ার বিষয়টি সামনে আনা হয় সরকারের পক্ষ থেকে। পরবর্তী সময়ে দেখা গেল, সেই ভবনে কোনো আগুনই লাগেনি। পাশের একটি ভবনের কাছে কিছু তার পুড়ে গিয়েছিল আর সেই দোহাই দিয়ে টানা ১০ দিন ইন্টারনেট বন্ধ রাখা হলো। তা ছাড়া ওই ভবন থেকে দেশজুড়ে মোট চাহিদার ২০ শতাংশের মতো ব্যান্ডউইডথ সরবরাহ করা হয়। আর মুঠোফোনে ইন্টারনেট বন্ধ রাখারই–বা ব্যাখ্যা কী?
ইন্টারনেট বন্ধ থাকা নিয়ে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্মেদ পলক যেভাবে একের পর বক্তব্য দিয়ে গেলেন, তা খুবই হাস্যকর। জনগণের কাছে এটা পরিষ্কার যে সরকার সিদ্ধান্ত নিয়ে ইন্টারনেট বন্ধ করে রেখেছিল এবং তা নিয়ে একের পর এক অসত্য ভাষ্য দিয়ে গেছে। অর্থনীতির করুণ দশার মধ্যে এর চেয়ে বড় আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত আর হয় না।
এখন ব্রডব্যান্ড ও মোবাইল ইন্টারনেট চালু করা হলেও তা এতটাই ধীরগতির যে সেই অর্থে কোনো সুফল দিচ্ছে না। করোনা পরিস্থিতিতে অনলাইন ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে কেন্দ্র করে ঘরে ঘরে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের যে জোয়ার তৈরি হয়, তা পুরোপুরি থমকে গেছে। অনলাইনে স্বাভাবিক যোগাযোগটাই করতে না পারায় ভোক্তাশ্রেণি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আছেন উদ্যোক্তারা।
প্রযুক্তি খাতে ফ্রিল্যান্সিং কার্যক্রমে বড় ধরনের ধস নেমেছে বলা যায়। গত এক দশকে বাংলাদেশের তরুণেরা ফ্রিল্যান্সিং করে যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা এনেছেন, পোশাক খাত ও রেমিট্যান্সের পাশাপাশি তা দেশের অর্থনীতিতে বড় ভিত তৈরি করেছে। ইন্টারনেট–সেবার করুণ দশা তৈরি করে সেই খাতকে হাতে ধরে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাওয়া হলো। প্রযুক্তি খাতের সংগঠকেরা বলছেন, ডেটা সেন্টার পুড়ে গিয়ে ইন্টারনেট-সেবা বন্ধ হয়েছে, এ কথা বিদেশি ক্রেতারা কেউ বিশ্বাস করছেন না। এতে তাঁরা বাংলাদেশের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলছেন।
সরকার সহিংসতা ও নাশকতায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ঠিকই উল্লেখ করছে, কিন্তু ইন্টারনেট বন্ধ থাকার কারণে কী পরিমাণ অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে, তার কোনো উল্লেখ নেই। ১০ দিন ইন্টারনেট বন্ধ রেখে বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি বা ইমেজের যে ক্ষতি হলো, তার মূল্য তো অনেক। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা এরই মধ্যে সতর্ক করে বলেছেন যে নির্ভরযোগ্য একটি বিনিয়োগ গন্তব্য হিসেবে বাংলাদেশের বিশ্বাসযোগ্যতা এখন প্রশ্নবিদ্ধ।
বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তি ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যুগে নিরবচ্ছিন্ন ইন্টারনেট সংযোগ এখন মানুষের মৌলিক অধিকারে পরিণত হয়েছে। ইন্টারনেট বন্ধ ও ধীরগতির করে রেখে সেই অধিকারের গুরুতর লঙ্ঘন করা হচ্ছে। সরকারের এই আচরণ পুরোপুরি অগণতান্ত্রিক। আর কোনো অজুহাত ও সময়ক্ষেপণ নয়। দ্রুত স্বাভাবিক গতির নিরবচ্ছিন্ন ইন্টারনেট চালু করে মানুষের স্বাভাবিক যোগাযোগ, দৈনন্দিন কার্যক্রমসহ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে সচল করুন।