শুধু উপদেশ নয়, সিস্টেম বদলাতে হবে

সম্পাদকীয়

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫৩তম সমাবর্তন অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য মো. আবদুল হামিদ বলেছেন, কিছু উপাচার্য ও শিক্ষকের কর্মকাণ্ডে শিক্ষকদের সম্মানের জায়গা ক্রমেই সংকুচিত হচ্ছে। কিছু কিছু উপাচার্যের ছেলেমেয়ে ও আত্মীয়স্বজনকে বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ দেওয়ার প্রবণতার সমালোচনাও করেন তিনি।

রাষ্ট্রপতির বক্তব্যে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস্তব চিত্রই উঠে এসেছে। তবে পুরোটা নয়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর হালচাল বুঝতে সমাবর্তনে রাষ্ট্রপতির ভাষণ শোনার দরকার হয় না। প্রথম আলোসহ প্রায় সব সংবাদমাধ্যমেই বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের অনিয়ম, দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার খবর প্রকাশিত হয়ে আসছে।

অতিসম্প্রতি জামালপুরের বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা ধর্মঘট করেন উপাচার্যের অনিয়ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে। এর আগে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য মেয়ে ও মেয়ের জামাতাকে বিধি সংশোধন করে নিয়োগ দিয়েছিলেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আপত্তি সত্ত্বেও।

রাষ্ট্রপতি যেসব উপাচার্যের কথা বলেছেন, তাঁদের নিয়োগকর্তা তিনি নিজেই। আইন অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি বা আচার্য তাঁদের নিয়োগ দিয়ে থাকেন। কিন্তু রাষ্ট্রপতি নিজেও জানেন না, কারা উপাচার্য পদে নিয়োগ পাচ্ছেন? নির্বাহী বিভাগ থেকে যেসব নাম সুপারিশ করা হয়, তিনি তাঁদেরই নিয়োগ দিয়ে থাকেন। বাংলাদেশের সংবিধানের ৪৮ অনুচ্ছেদের ৩ উপধারায় আছে, ‘কেবল প্রধানমন্ত্রী ও ৯৫ অনুচ্ছেদের (১) দফা অনুসারে প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্র ব্যতীত রাষ্ট্রপতি তাহার অন্য সকল দায়িত্ব পালনে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী কার্য করিবেন।’

সরকার তাঁদেরই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে নিয়োগ দিয়ে থাকে, যাঁরা ক্ষমতাসীনদের প্রতি শতভাগ অনুগত থাকবেন। এখানে যোগ্যতা কোনো মাপকাঠি নয়। সমস্যাটা যতটা না ব্যক্তির, তার চেয়ে বেশি সিস্টেম বা পদ্ধতিগত। প্রকৃতপক্ষে এমন ব্যক্তিরই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হওয়ার কথা, সেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনায় যার থাকবে প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা ও একাডেমিক উৎকর্ষ। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, বেশির ভাগ উপাচার্যের এসব নেই। তাঁরা ক্ষমতাসীনদের স্তুতি-তোয়াজ করে উপাচার্য হন। রাষ্ট্রপতি যেদিন উপাচার্যদের প্রতি উপদেশ দিয়েছেন, সেদিনই শিক্ষাবিষয়ক একটি সেমিনারে অর্থনীতিবিদ আনু মুহাম্মদ এক সেমিনারে বলেছেন, উপাচার্য নিয়োগ থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের বারোটা কাজার কাজ শুরু হয়।

এটা সবাই স্বীকার করেছেন যে বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষার মান কমে যাওয়ার বড় কারণ এর রাজনীতিকীকরণ। প্রতিটি সরকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে কুক্ষিগত করতে চায়, যা কেবল অনভিপ্রেত নয়, উচ্চশিক্ষার জন্য আত্মঘাতীও। পৃথিবীর অনেক দেশেই সার্চ কমিটির মাধ্যমে উপাচার্য নিয়োগ করা হয়। আমরা সে রকম কোনো ব্যবস্থা দাঁড় করাতে পারলাম না।

১৯৭৩ সালের বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ অনুযায়ী সিনেটের মাধ্যমে উপাচার্য নিয়োগ হওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, সিনেট তিন সদস্যের যে প্যানেল নির্বাচন করে, অনেক ক্ষেত্রেই শীর্ষ ব্যক্তিকে নিয়োগ দেওয়া হয় না। সরকারের প্রতি সবচেয়ে বেশি আনুগত্য যঁার আছে, তিনিই নিয়োগ পেয়ে থাকেন। মাত্র চারটি বিশ্ববিদ্যালয় এই অধ্যাদেশের অন্তর্ভুক্ত। বাকি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় নিয়োগের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ রাজনৈতিক বিবেচনা ছাড়া আর কিছুই কাজ করে না।

উপাচার্য হওয়ার ন্যূনতম যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও অনেকে পদায়িত হয়ে থাকেন। অনেক বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয়েও উপাচার্য পদে এমন ব্যক্তিদের নিয়োগ করা হয়, যঁাদের বিশেষায়িত বিষয়ে কোনো জ্ঞানই নেই। এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হলে উপাচার্য নিয়োগে সরকারের একক কর্তৃত্ব খর্ব করার বিকল্প নেই। সিস্টেম না বদলাতে পারলে রাষ্ট্রপতির উপদেশ বা খেদ কোনো কাজে আসবে না। রাষ্ট্রপতি নিজেই উপাচার্য নিয়োগের এই সিস্টেমের অংশ।