পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর চুক্তি সই করা হলেও গত ২৭ বছরে এর অনেক কিছু অবাস্তবায়িত থেকে গেছে। এ নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি জনগোষ্ঠী ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখালেও বিগত কোনো সরকার সেখানকার সমস্যা সমাধানে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি।
চুক্তি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া পরিবীক্ষণ করতে যে উচ্চপর্যায়ের কমিটি করা হয়েছিল, রাজনৈতিক কারণেই তা এত দিন সক্রিয় করা যায়নি। বিভিন্ন সময়ে এমন ব্যক্তিকে কমিটির প্রধানের দায়িত্ব দেওয়া হতো, যিনি নিজে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন না, এমনকি বৈঠক করার সময়ও দিতেন না। ফলে চুক্তি তদারকির কাজটি আর এগোয়নি।
গত ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর স্বাভাবিকভাবে আগের পরিবীক্ষণ কমিটি বাতিল হয়ে যায়। এ অবস্থায় ১২ জানুয়ারি পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেনকে প্রধান করে সরকার যে নতুন পরিবীক্ষণ কমিটি গঠন করেছে, বিলম্বে হলেও তাকে স্বাগত জানাই। কমিটির অপর দুই সদস্য হলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা ও এ–বিষয়ক টাস্কফোর্সের চেয়ারম্যান সুদত্ত চাকমা।
পুনর্গঠিত কমিটির কাজ প্রসঙ্গে সরকারি প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, কমিটি পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া পরিবীক্ষণ ও তত্ত্বাবধানের পাশাপাশি চুক্তি বাস্তবায়নসংক্রান্ত সমস্যা সমাধানের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে এবং প্রয়োজনে সরকারের কাছে সুপারিশ করবে।
২৭ বছর আগে পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরিত হলেও এর মৌলিক ধারাগুলো বাস্তবায়িত হয়নি বলে অভিযোগ পাহাড়ের আঞ্চলিক সংগঠনগুলোর। অন্যদিকে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হতো, চুক্তির বেশির ভাগ ধারা বাস্তবায়িত হয়েছে। গত বছরের ২৪ আগস্ট সংবাদ সম্মেলন করে অন্তর্বর্তী সরকারের কর্মসূচিতে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন অগ্রাধিকার তালিকায় রাখার দাবি জানিয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলন। গত নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে একই দাবিতে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে চিঠি দেয় সংগঠনটি।
সে ক্ষেত্রে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি পরিবীক্ষণ কমিটি পুনর্গঠন এক ধাপ অগ্রগতি বলে মনে করি। আশা করি, পুরোনো কমিটিকে কাজের ক্ষেত্রে যেসব সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়েছে, বর্তমান কমিটিকে তা হতে হবে না। তারা পার্বত্য চট্টগ্রামের এখনকার সমস্যা সমাধানে সরকারকে বাস্তবমুখী পরামর্শ দিতে পারবে।
দলীয় সরকারগুলো পার্বত্য চট্টগ্রামের গোটা জনগোষ্ঠীর দাবিদাওয়া বাস্তবায়নের চেয়ে দলীয় আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় বেশি উদ্গ্রীব ছিল। যেহেতু অন্তর্বর্তী সরকারের দলীয় কোনো অভিলাষ নেই, সেহেতু তারা খোলামনে সমস্যাগুলো আলোচনা করে যৌক্তিক সমাধানের পথ বের করতে পারবে।
সর্বোপরি পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার স্থায়ী সমাধান করতে হলে এর যে মূল সমস্যা ভূমি বিরোধ, তাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। দুর্ভাগ্য হলো চুক্তির পর ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তিতে একাধিক কমিশন গঠিত হলেও তারা কাজ করতে পারেনি। ভূমি বিরোধ কমিশন যাতে নির্ভয়ে কাজ করতে পারে, সেই পরিবেশ তৈরি করাও সরকারের দায়িত্ব।
পার্বত্য চুক্তির অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল সেখানকার পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর স্বকীয় সত্তা, সংস্কৃতি ও জীবনধারাকে সমুন্নত রাখা। গত আড়াই দশকে সেখানকার অর্থনীতি ও অবকাঠামো উন্নয়নে নানা কর্মসূচি নেওয়া হলেও এ বিষয়ে কোনো অগ্রগতি নেই। চুক্তির অনেক গুরুত্বপূর্ণ শর্ত প্রতিপালিত না হওয়ায় পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর মধ্যে যে ভয়ের পরিবেশ তৈরি হয়েছে, সেটা দূর করতে হবে পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য। এ ক্ষেত্রে পরিবীক্ষণ কমিটি সরকার ও পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর সেতুবন্ধ হিসেবে কাজ করতে পারে।