চাঁদাবাজদের দৌরাত্ম্যের খবর পাড়া-মহল্লা ছাড়িয়ে এখন জাতীয় সংসদ ও সচিব সভা পর্যন্ত পৌঁছেছে। সম্প্রতি সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন জাতীয় সংসদে ‘জরুরি জনগুরুত্বসম্পন্ন বিষয়ে মনোযোগ আকর্ষণ’ নোটিশের আলোচনায় অংশ নিয়ে বলেছেন, তাঁর নির্বাচনী এলাকা সিলেটে কিছু সন্ত্রাসী নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যবাহী ট্রাক থেকে নিয়মিত চাঁদা আদায় করছে। চাঁদাবাজদের অত্যাচারে ব্যবসায়ীরা অত্যন্ত অসন্তুষ্ট। এই চাঁদাবাজি বন্ধ এবং চাঁদাবাজির মাধ্যমে আদায় করা টাকা বাজেয়াপ্ত করতে সরকারের প্রতি আহ্বান তিনি।
কিছুদিন আগেও পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে এ কে আব্দুল মোমেন সরকারের সব কাজের পক্ষে সাফাই গাইতেন। এখন নিজেই চাঁদাবাজি বন্ধের আহ্বান জানাচ্ছেন।
সোমবার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত ‘সচিব সভায়’ও চাঁদাবাজির বিষয়টি উঠে আসে। বলা হয়, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির অন্যতম কারণ পণ্য পরিবহনে চাঁদাবাজি। তাই এ বিষয়ে খুবই শক্ত ব্যবস্থা নিতে সচিবদের প্রতি নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
১ ফেব্রুয়ারি প্রথম আলোর খবরে বেরিয়ে আসে ঢাকার চাঁদাবাজির ভয়াবহ তথ্য। জমি কেনা, বাড়ি নির্মাণ কিংবা ব্যবসা করতে গেলে সন্ত্রাসীদের চাঁদা দিতে হয়। চাঁদা দিলে নির্বিঘ্নে কাজ করতে পারেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা, না দিলে মারধরের শিকার হতে হয়। মিরপুরের মাজার রোডে আয়েশা সুপার মার্কেটের সামনের এক মুদিদোকানি ডিএমপি কমিশনারের কাছে লিখিত অভিযোগ করেছেন, সন্ত্রাসীদের দাবি অনুযায়ী দুই লাখ টাকা চাঁদা না দেওয়ায় তাঁকে মারধর ও দোকান ভাঙচুর করা হয়েছে।
তবে ওই দোকানির মতো সবাই থানা-পুলিশের কাছে যান না বা যেতে ভয় পান। ফলে ঢাকা শহরে হামেশা চাঁদাবাজি হলেও থানায় মামলা করেন না ভুক্তভোগীরা। মামলা না করার কারণ, প্রতিকার পাওয়া যায় না। উল্টো চাঁদাবাজদের হাতে অনেককে নিগ্রহের শিকার হতে হয়। গত সাত মাসে রাজধানীতে চাঁদাবাজি ও হামলাসংক্রান্ত ১৪টি ঘটনার তথ্য পাওয়া গেছে। এ সময় চাঁদাবাজদের হাতে একজন নিহত ও নয়জন আহত হয়েছেন। এই পরিসংখ্যান অবিশ্বাস্য বললেও কম বলা হবে। থানায় চাঁদাবাজির মামলা না নেওয়ার ক্ষেত্রে অলিখিত নির্দেশ আছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। চাঁদাবাজি–ছিনতাইয়ের ঘটনায় চুরির মামলা নেওয়া হয়।
ডিএমপির সাবেক কমিশনার নাইম আহমেদ বলেছেন, প্রতিটি অভিযোগ গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করে এর সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনা গেলে চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। তাঁর সময়ে প্রতিটি ঘটনায় মামলা হয়েছে, এমনটি বলা যাবে না।
প্রথম আলোর খবর থেকে আরও জানা যায়, রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় চাঁদাবাজি হয় পলাতক ও কারাবন্দী শীর্ষ সন্ত্রাসীদের নামে। চাঁদাবাজদের তালিকায় ক্ষমতাসীন দল ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীদেরও নাম আসে। যখনই চাঁদাবাজির কোনো ঘটনার সঙ্গে ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতা-কর্মীর নাম আসে, তখনই সংগঠন থেকে তঁাদের বহিষ্কার করা হয়। কিন্তু যে সংগঠনের নাম ব্যবহার করে তঁারা এসব কাণ্ড করে থাকেন, তাঁদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থার নজির খুব কম।
ক্ষমতার শীর্ষ মহল থেকে চাঁদাবাজি ঠেকাতে শূন্য সহিষ্ণুতা দেখানোর কথা বলা হলেও বাস্তবে তার প্রতিফলন নেই। কেবল ঢাকা বা সিলেট নয়, সারা দেশেই চাঁদাবাজির ঘটনা ঘটছে। সরকার বদলায়, মন্ত্রিসভা ও সংসদে পুরোনো মুখের বদলে নতুন মুখ আসে। কিন্তু চাঁদাবাজদের দৌরাত্ম্য চলতেই থাকে। এই চাঁদাবাজদের খুঁটির জোর কোথায়, অনুগ্রহ করে জানাবেন কি?