শিশুর বিকাশের পরিবেশ নিশ্চিত করুন

কারাগারের কনডেমড সেলে মায়ের সঙ্গে থাকা শিশুর শারীরিক ও মানসিক উন্নয়ন নিশ্চিতে বিধি বা নীতিমালা বা প্রবিধান তৈরি করার বিষয়ে হাইকোর্ট যে রুল জারি করেছেন, আমরা তাকে স্বাগত জানাই। গত রোববার কনডেমড সেলে মায়ের সঙ্গে শিশুটির থাকা, তার অবস্থা-সম্পর্কিত বিষয়ে তদন্ত করে কারা মহাপরিদর্শক ও হবিগঞ্জের কারা কর্তৃপক্ষকে আগামী ১৮ জানুয়ারি প্রতিবেদন দিতে বলেছেন বিচারপতি নাইমা হায়দার ও বিচারপতি কাজী জিনাত হকের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ।

গত ৩০ নভেম্বর একটি দৈনিক পত্রিকায় ‘ফাঁসির সেলে কেমন আছে ১০ মাসের মাহিদা’ শিরোনামে প্রতিবেদন ছাপা হয়। এতে বলা হয়, হবিগঞ্জে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের এক মামলায় মায়ের মৃত্যুদণ্ডের রায় হওয়ায় তাঁর সঙ্গেই ফাঁসির সেলে আছে ১০ মাসের শিশু মাহিদা। প্রতিবেদনটি যুক্ত করে শিশুটির জন্য পর্যাপ্ত খাবার, স্বাস্থ্যকর পরিবেশ ও অন্যান্য মৌলিক চাহিদা পূরণ নিশ্চিতে নির্দেশনা চেয়ে ১৪ ডিসেম্বর একটি রিট করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী তানভীর আহমেদ।

উল্লেখ্য, ফাঁসির সেলের আয়তন প্রায় ১০ ফুট বাই ১০ ফুট, সেলগুলোয় পর্যাপ্ত আলো-বাতাস এবং সরাসরি পানির কোনো ব্যবস্থা নেই। দিনে দেড় ঘণ্টার জন্য সেলের তালা খুলে দেওয়া হয়। সারা রাত জ্বলে উচ্চ আলোসম্পন্ন বৈদ্যুতিক বাতি। একজন সশ্রম সাজাপ্রাপ্ত কারাবন্দী যে হারে খাবার পান, ফাঁসির সেলে বন্দী মায়েদেরও একই নিয়মে খাবার দেওয়া হয়। এর অর্থ শিশুর জন্য আলাদা কোনো খাবার দেওয়া হয় না।

সম্প্রতি চাইল্ডস রাইটস অ্যাডভোকেসি কোয়ালিশন ইন বাংলাদেশের (সিআরএসি) তথ্যমতে, দেশের ৬৮টি কারাগারে মায়ের সঙ্গে কারাযাপন করছে ৩০৪টি শিশু। সংগঠনটি মনে করে, বিদ্যমান আইনি কাঠামো দণ্ডপ্রাপ্ত আসামির সন্তানের অধিকার সুরক্ষার জন্য যথেষ্ট নয়। কারা কর্তৃপক্ষকে মনে রাখতে হবে, কনডেমড সেলে থাকা নারী অপরাধ করলেও তাঁর শিশুসন্তান কোনো অপরাধ করেনি। কনডেমড সেলের নিয়মকানুন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত মায়ের জন্য প্রযোজ্য হলেও তাঁর শিশুসন্তানের জন্য হতে পারে না।

এখানে দুটি মানবিক প্রশ্ন—মায়ের সঙ্গে শিশুর থাকার অধিকার; দ্বিতীয়ত, শিশুর মানসিক ও শারীরিক বিকাশের জন্য সুস্থ–স্বাভাবিক পরিবেশ, যা কনডেমড সেলে সম্ভব নয়। হবিগঞ্জ কারাগারের খবরটি সংবাদমাধ্যমে এসেছে বলে দেশবাসী জানতে পেরেছে এবং আদালতে রিট হয়েছে। আরও কোনো কারাগারে কনডেমড সেলে মায়ের সঙ্গে শিশু আছে কি না, সেটাও খতিয়ে দেখা দরকার। সব কারাগারের নারী ওয়ার্ডে ডে কেয়ার সেন্টার থাকে, যেখানে শিশুরা খেলাধুলা করতে পারে। কিন্তু আমাদের ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই কারাগারগুলোর অবস্থা হলো ‘কাজির গরু কাগজে আছে, গোয়ালে নেই’। সেখানে মায়ের সঙ্গে থাকা শিশুর কথা কমই ভাবা হয়।

কারাগারকে দেখতে হবে সংশোধনাগার হিসেবেই, বন্দিশালা হিসেবে নয়। উন্নত দেশগুলোর কথা বাদ দিলেও প্রতিবেশী ভারতেও কারাগারের সার্বিক পরিবেশ অনেক উন্নত। আমরা সেই ঔপনিবেশিক আইনের নিগড় থেকে বেরিয়ে আসতে পারিনি। কারাগারে মায়েদের সঙ্গে থাকা শিশুদের ক্ষেত্রে দুটি বিকল্প ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। যেসব মা শিশুসহ কারাবন্দী, তাঁদের জন্য আলাদা উন্নত পরিবেশ এবং শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ–সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে।

কারা কর্তৃপক্ষ নিজ থেকে মায়ের সঙ্গে থাকা শিশুদের মানসিক ও শারীরিক বিকাশের জন্য আলাদা কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। আশা করি, উচ্চ আদালতের রুলের পর তারা এ বিষয়ে দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে।