পরিবেশ ও অবকাঠামো উন্নয়ন জরুরি

সম্পাদকীয়

দুটি গবেষণা জরিপের বরাতে সম্প্রতি প্রথম আলোয় মফস্‌সলে কর্মরত চিকিৎসকদের বিভিন্ন সমস্যা উঠে এসেছে। ১৯ এপ্রিলের পত্রিকায় চিকিৎসা ও জনস্বাস্থ্যবিষয়ক সাময়িকী ল্যানসেট-এর গবেষণায় চিকিৎসকদের ১৮টি সমস্যা উল্লেখ করা হয়েছে। ৪ এপ্রিল প্লস গ্লোবাল পাবলিক হেলথ জার্নালে প্রকাশিত জরিপে ৯৬ শতাংশ চিকিৎসক জানিয়েছেন কেন তাঁরা গ্রামে থাকতে চান না। তবে গ্রাম বা মফস্‌সলে স্বাস্থ্যসেবার বেহাল জানতে গবেষণারও প্রয়োজন হয় না। প্রতিদিন মফস্‌সল থেকে ঢাকা বা অন্যান্য বড় শহরে রোগীদের স্রোত দেখলেই সেটা উপলব্ধি করা যায়।

দুটি গবেষণার শিরোনাম ভিন্ন হলেও উদ্দেশ্য অভিন্ন। এতে চিকিৎসাসেবায় অবকাঠামোগত দুর্বলতা, চিকিৎসা সেবাকক্ষ ও সরঞ্জামের অপ্রতুলতা, স্বাস্থ্যকর্মীর ঘাটতি, নিরাপত্তাহীনতা, আবাসন সমস্যা উঠে এসেছে। শেষোক্ত গবেষণায় স্থানীয় প্রভাবশালীদের চাপ ও চিকিৎসকদের সঙ্গে দুর্ব্যবহারের কথাও বলা হয়েছে। অনেক সময় স্বাস্থ্যকর্মী ও সরঞ্জামের ঘাটতির কারণে রোগীরা সেবা থেকে বঞ্চিত হয়ে চিকিৎসকদের ওপর চড়াও হন। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক।

সরকার যদি সত্যি সত্যি গ্রামাঞ্চলে উন্নত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে চায়, তাহলে সেখানে প্রয়োজনীয় সংখ্যক চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগ দিতে হবে। তিনজনের কাজ একজনকে দিয়ে করানোর মানসিকতা পরিহার করতে হবে। অন্য ক্ষেত্রে সময়ক্ষেপণ সম্ভব হলেও চিকিৎসায় সেটি চলে না। গ্রামে এমন অবকাঠামো ও যোগাযোগব্যবস্থা রাখতে হবে, যাতে চিকিৎসক কিংবা অন্য সরকারি কর্মকর্তারা সেখানে যেতে উৎসাহিত হন।

গ্রামে চিকিৎসকদের আবাসনের সমস্যাটি নিয়ে অনেক দিন ধরে আলোচনা হলেও পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়ার ব্যাখ্যা কী? অনেক স্থানে চিকিৎসকদের আবাসনের কোনো ব্যবস্থা নেই। আবার অনেক স্থানে ঘর আছে, কিন্তু বসবাসের উপযোগী নয়।

সরকার অনুৎপাদনশীল ও অগুরুত্বপূর্ণ কাজে অনেক টাকা খরচ করলেও স্বাস্থ্য খাতে মুঠো আলগা করতে চায় না। দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশেই স্বাস্থ্যসেবায় বরাদ্দের হার সবচেয়ে কম। আবার এই বরাদ্দের সিংহভাগ চলে যায় শহরাঞ্চলে। ফলে দুয়োরানির মতো গ্রামাঞ্চলের জন্য নগণ্য বরাদ্দ থাকে। ফলে চিকিৎসকদের নানা সমস্যার মুখে পড়তে হয়।

কিন্তু জরিপে নীতি–সম্পর্কিত যে সমস্যার কথা বলা হয়েছে, সেটা দূর করতে তো বাড়তি অর্থের প্রয়োজন হয় না। প্রয়োজন সৎ ও স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গি। যদি অবস্থা এমন হয় যে যাঁর তদবিরের জোর বেশি, তিনি দ্রুত গ্রাম থেকে শহরে পদায়ন পেয়ে যান, তাহলে অন্য চিকিৎসকেরাও গ্রাম থাকতে চাইবেন না। এর সমাধান কী? গ্রামে চিকিৎসক রাখতে হলে স্বাস্থ্য বিভাগে ‘তদবির সংস্কৃতি’র অবসান ঘটাতে হবে।

সরকারের নীতিনির্ধারকেরা মাঝেমধ্যেই চিকিৎসকদের গ্রামে যাওয়ার জন্য ‘কঠোর’ নির্দেশ দেন, কিন্তু সেই নির্দেশ কেন প্রতিপালিত হচ্ছে না, সেটা তাঁরা খতিয়ে দেখেন না। সম্প্রতি স্বাস্থ্যমন্ত্রী সামন্ত লাল সেন সোসাইটি অব নিউরোসার্জনস অব বাংলাদেশের (এসএনবি) দশম জাতীয় নিউরোলজি কনফারেন্সে চিকিৎসা খাতে সুনাম ফিরিয়ে আনতে হলে প্রত্যন্ত অঞ্চলে ভালো চিকিৎসাসেবা পৌঁছে দেওয়া এবং চিকিৎসকদের সেখানে থাকার ওপর জোর দিয়েছেন। সেই সঙ্গে তিনি গ্রামে যাঁরা স্বাস্থ্যসেবা দেবেন, তাঁদের সুযোগ–সুবিধা বাড়ানো হবে বলেও অঙ্গীকার করেছেন।

এর আগে একাধিক স্বাস্থ্যমন্ত্রী এ ধরনের কথা বললেও বাস্তবে তার প্রতিফলন দেখা যায়নি। চিকিৎসাক্ষেত্রে সুনাম অর্জনকারী বর্তমান স্বাস্থ্যমন্ত্রী তাঁর কথা রাখবেন বলেই আমরা আশা করি।