পাঠ্যবই নিয়ে এই স্বেচ্ছাচারিতার শেষ কোথায়

প্রতিবছরই পাঠ্যবইয়ের ছাপার মান নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। বছরের শুরুতে শিক্ষার্থীদের হাতে বই পৌঁছানো যেমন আনন্দের; কিন্তু এই আনন্দ বিষাদে পরিণত হয়, যখন তা হয় ভুলে ভরা ও নিম্নমানের ছাপা। 

পাঠ্যবই ছাপার দায়িত্ব জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি)। তারা কাজটি করে তালিকাভুক্ত মুদ্রণপ্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। বই ছাপতে দেরি হওয়া কিংবা নিম্নমানের ছাপা কাগজ নিয়ে এনসিটিবি ও মুদ্রণপ্রতিষ্ঠানগুলো একে অপরের ওপর দোষ চাপিয়ে নিজের দায় এড়াতে চায়।

প্রথম আলোর খবর থেকে জানা যায়, নতুন বছরের শুরুতে শিশুদের হাতে বিনা মূল্যে যে পাঠ্যবই দেওয়া হয়েছে, তা অনেক ক্ষেত্রে ছাপা হয়েছে অযত্ন-অবহেলায়। কাগজের মানে আগের চেয়ে অবনতি হয়েছে। ছাপাও হয়েছে নিম্নমানের। সপ্তম শ্রেণির ‘ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান’ বইয়ের একটিতে ৬৬ নম্বর পৃষ্ঠায় আরও কয়েকজনের সঙ্গে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একটি ছবি রয়েছে। কিন্তু ছবি পরিচিতি (ক্যাপশন) পড়া ছাড়া বোঝার উপায় নেই যে সেটা বঙ্গবন্ধুর। ছবিতে থাকা অন্যদেরও কোনোভাবেই চেনা যায় না।

কেবল ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান নয়; আরও কয়েকটি বইয়ে নিম্নমানের কাগজ ও ছাপার অভিযোগ পাওয়া গেছে। মুদ্রণবিভ্রাটে সাতক্ষীরার শিক্ষার্থীদের দেওয়া তৃতীয় শ্রেণির ইসলাম শিক্ষার ৩১ হাজারের বেশি বই ফেরত নেওয়া হয়েছে। গেল বছর পাঠ্যবইয়ে ভুল ও অসংগতি নিয়ে বিতর্কের পর শিক্ষাবর্ষের মধ্যেই ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির দুটি বই (ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বিষয়ের অনুসন্ধানী পাঠ) আকস্মিকভাবে প্রত্যাহার করা হয়। এবার বই দুটি পাঠ্য হিসেবেই রাখা হয়নি। 

এসব ভুল ও অসংগতি এনসিটিবি কর্মকর্তাদের চরম দায়িত্বহীনতার পরিচয়। প্রশ্ন হলো যে প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে লাখ লাখ শিক্ষার্থীর লেখাপড়ার বিষয়টি সরাসরি যুক্ত, সেটা কি এভাবেই চলতে থাকবে? প্রতিবছর পাঠ্যবই নিয়ে এই স্বেচ্ছাচারিতা কেন? 

প্রথম আলো গত ডিসেম্বরেই বইয়ের ছাপার ধীরগতি নিয়ে প্রতিবেদন ও সম্পাদকীয় প্রকাশ করেছিল। এই প্রতিবেদনের পর পাঠ্যবই ছাপায় গতি কিছুটা বাড়লেও মানের অবনতি হওয়া দুঃখজনক। এনসিটিবি বিশ্ববাজারে ভালো মণ্ড বা পাল্প না পাওয়ায় কাগজের উজ্জ্বলতা ৮৫ থেকে কমিয়ে ৮০ শতাংশ করা হয়েছিল। এনসিটিবির চেয়ারম্যান চিকিৎসকদের বরাত দিয়ে বলেছেন, কাগজের উজ্জ্বলতা ৮০ শতাংশ থাকাই শিক্ষার্থীদের চোখের জন্য ভালো। কিন্তু চেয়ারম্যান মহোদয় দয়া করে বলবেন কি অস্পষ্ট ও ঝাপসা ছাপা তাদের চোখের জন্য, তাদের মানসিক প্রশান্তির জন্য কতটা মঙ্গলজনক?

নিম্নমানের ছাপা পাঠ্যবই শিক্ষার্থীদের হাতে দিয়ে এনসিটিবি অমার্জনীয় অপরাধ করেছে। এ বিষয়ে এনসিটিবির চেয়ারম্যান মো. ফরহাদুল ইসলাম প্রথম আলোকে যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন, তা একেবারে অগ্রহণযোগ্য। তিনি বলেছেন, ৩১ কোটি বইয়ের মধ্যে কিছুসংখ্যক বইয়ের ছাপার মান খারাপ। 

মুদ্রণবিভ্রাটের কারণে সাতক্ষীরা জেলা থেকে যখন বই ফেরত আনা হয়েছে, তখন অস্পষ্ট ও ঝাপসা ছাপার বই অনেক জেলায় পাওয়া যেতে পারে। প্রতিটি বই ছাপার পর নমুনা কপি পরীক্ষা করার নিয়ম আছে। এখানে কি সেই নিয়ম মানা হয়নি অথবা যাঁদের ওপর পরীক্ষা করার দায়িত্ব ছিল, তাঁরা কি না দেখেই অনুমোদন দিয়েছেন? 

সে ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের কাছে নিম্নমানের বই যাওয়ার দায় কেবল মুদ্রণপ্রতিষ্ঠানের ওপর চাপালে হবে না; এনসিটিবিকেও এর দায়িত্ব নিতে হবে। নিয়ম রক্ষার তদন্ত কমিটি নয়; যাদের কারণে অযত্ন–অবহেলায় অস্পষ্ট ও ঝাপসা ছাপার বই শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছেছে, তাদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে।