পরিবেশঘাতী ‘বোমা মেশিন’ আর না

সম্পাদকীয়

পঞ্চগড়ের পাথরমহালে আপাতত ‘বোমা মেশিন’ নেই—এই তথ্য স্বস্তির হলেও আত্মতুষ্টির কারণ নেই। অভিজ্ঞতা বলছে, প্রশাসনিক নজরদারিতে সামান্য শৈথিল্য এলেই এই পরিবেশবিধ্বংসী অবৈধ যন্ত্র আবার ফিরে আসতে পারে। অতীতে বারবার তা ঘটেছে। ফলে প্রশ্নটি আর ‘আছে কি নেই’-এর মধ্যে সীমিত নয়; বরং প্রশ্নটি হলো, রাষ্ট্র ও সমাজ কি এই ধ্বংসাত্মক প্রবণতাকে স্থায়ীভাবে রুখতে প্রস্তুত?

বোমা মেশিনের ব্যবহার প্রকৃতপক্ষে উন্নয়ন বা উৎপাদনের কোনো যুক্তিসংগত পদ্ধতি নয়। এটি নদীর তলদেশকে অস্বাভাবিকভাবে ক্ষতবিক্ষত করে, মাটির প্রাকৃতিক স্তর ভেঙে দেয়, ভূগর্ভস্থ পানির ভারসাম্য নষ্ট করে। পঞ্চগড় হিমালয়ের পাদদেশে অবস্থিত। এই ভূপ্রাকৃতিক বাস্তবতায় নির্বিচারভাবে শক্তিশালী পাম্প দিয়ে পাথর উত্তোলন মানে ভূমিধস, নদীর গতিপথ বদল এবং দীর্ঘ মেয়াদে ভূমিকম্পঝুঁকি বাড়িয়ে দেওয়া।

বোমা মেশিন দিয়ে অতিরিক্ত পরিমাণে পাথর তোলায় ইতিমধ্যে তেঁতুলিয়ার বিস্তীর্ণ এলাকায় সমতল জমি গভীর গর্তে পরিণত হয়েছে, বহু একর জমি বছরের পর বছর অনাবাদি পড়ে আছে। এই ক্ষতি কেবল আজকের নয়; এর বোঝা বহন করতে হবে আগামী প্রজন্মকেও।

এই ধ্বংসের পেছনে যারা আছে, তারা অচেনা কেউ নয়। একটি সুসংগঠিত স্বার্থান্বেষী চক্র—যাদের মধ্যে প্রভাবশালী ব্যবসায়ী, ইজারাব্যবস্থার সুবিধাভোগী এবং বিভিন্ন সময়ের রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয়ে বড় হয়ে ওঠা লোকজন রয়েছে, তারাই বোমা মেশিনকে বারবার ফিরিয়ে আনে।

রাজনৈতিক পরিচয় এখানে মুখ্য নয়; অতীতে যেমন ক্ষমতাসীনদের ছত্রচ্ছায়ায় এই অবৈধ কাজ চলেছে, সাম্প্রতিক মামলার নথিতে দেখা যাচ্ছে, ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক পরিচয়ের মানুষও এতে জড়িত; অর্থাৎ সমস্যাটি দলীয় নয়, এটি ক্ষমতার অপব্যবহার ও লোভের রাজনীতি। এই বাস্তবতা এড়িয়ে গিয়ে যদি দায় কেবল ‘পরিস্থিতির’ ঘাড়ে চাপানো হয়, তবে তা হবে আত্মপ্রবঞ্চনা।

সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো, এই চক্র নিজেদের স্বার্থ রক্ষায় সাধারণ শ্রমিকদের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে। বাস্তবে পাথরমহালের শ্রমিকদের বড় অংশই বোমা মেশিনের বিরুদ্ধে। কারণ, তারা জানে, যন্ত্র মানেই শ্রমিকের কাজ কমে যাওয়া, দ্রুত পাথর শেষ হয়ে যাওয়া এবং শেষ পর্যন্ত নিজেদেরই জীবিকা হারানো। সনাতন পদ্ধতিতে পাথর উত্তোলন শ্রমসাপেক্ষ, কিন্তু এতে হাজারো মানুষের রুটি-রুজির সুযোগ তৈরি হয়।

তাই আইন প্রয়োগের নামে যদি নির্বিচার শ্রমিকদের হয়রানি করা হয়, অথচ মূল উদ্যোক্তা ও পৃষ্ঠপোষকেরা যদি থেকে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরে, তাহলে তা ন্যায়ের পরিপন্থী হবে।

এই সংকট মোকাবিলার পথ একটাই—আইনের নিরপেক্ষ ও ধারাবাহিক প্রয়োগ। বোমা মেশিন বসানো, পরিচালনা করা এবং এতে অর্থায়নের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। একই সঙ্গে শ্রমিকদের জন্য সনাতন, পরিবেশসম্মত পদ্ধতিতে কাজের সুযোগ টিকিয়ে রাখা এবং তা আরও নিরাপদ করার উদ্যোগ প্রয়োজন।