সময় নির্ধারণে দুই দেশের সমন্বয় জরুরি

সম্পাদকীয়

কবি বুদ্ধদেব বসু ইলিশকে ‘জলের উজ্জ্বল শস্য’ হিসেবে অভিহিত করলেও যাঁরা এই মাছ ধরেন, তাঁদের জীবন মোটেই উজ্জ্বল নয়। বিশেষ করে যখন ইলিশ ধরার ওপর নিষেধাজ্ঞা থাকে, তখন জেলেদের জীবনধারণই কঠিন হয়ে পড়ে। সরকারের পক্ষ থেকে যে আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়, তাতে পরিবার–পরিজন নিয়ে তাঁদের অন্নের সংস্থান হয় না।

গত ২৮ জুন প্রথম আলোয় ইলিশ ধরার ওপর সরকারের নিষেধাজ্ঞার আরেকটি নেতিবাচক প্রভাবের কথা জানা গেল। সরকার মাছ উৎপাদন বাড়ানোর উদ্দেশ্যে নিষেধাজ্ঞা দেয়। কিন্তু এক মাসের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে চলা নিষেধাজ্ঞার সময় ভারতের পশ্চিমবঙ্গের উপকূলে বেশি ইলিশ ধরা পড়ে। অন্যদিকে বাংলাদেশে ভরা মৌসুমে ইলিশ কম ধরা পড়ছে বলে জানিয়েছেন মৎস্যজীবীরা।

বাংলাদেশে ইলিশ সুরক্ষায় তিন মেয়াদে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। এর মধ্যে অক্টোবরে ২২ দিন। এ সময় মা মাছের ডিম ছাড়ার সুযোগ দেওয়া হয়। এরপর বাচ্চা ইলিশের সুরক্ষায় ১ মার্চ থেকে ৩০ এপ্রিল, দুই মাস নিষেধাজ্ঞা থাকে। মাছের বৃদ্ধির জন্য ২০ মে থেকে ২৩ জুলাই আরেক দফা সাগরে নিষেধাজ্ঞা থাকে। ভারতে নিষেধাজ্ঞা থাকে ১৫ এপ্রিল থেকে ১৪ জুন পর্যন্ত। ১৫ জুন ভারতীয় উপকূলে মাছ ধরা হয়।

বিষয়টি রাজনৈতিক দৃষ্টিতে দেখার কোনো সুযোগ নেই। দুই দেশের বিশেষজ্ঞদের বসে ঠিক করতে হবে, কখন নিষেধাজ্ঞা দিলে উভয়ই লাভবান হবে। উল্লেখ্য, ইলিশের উৎপাদন বাড়াতে বাংলাদেশ অনেক আগে থেকে নিষেধাজ্ঞার বিধান চালু করলেও ভারত শুরু করেছে ২০১৮ সালে।

বাংলাদেশে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ইলিশের উৎপাদন ছিল ৫ লাখ ৩৩ হাজার মেট্রিক টন। চার বছরে বার্ষিক উৎপাদন ৬ লাখ ২০ হাজার টন বা ১৬ শতাংশ বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে মৎস্য অধিদপ্তর। তবে ৩ বছরে ৬ দশমিক ৩৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে, যা লক্ষ্যমাত্রার অর্ধেকের কম।

দেশে ইলিশের উৎপাদন বাড়াতে ভারত ও বাংলাদেশ মিলে একটি অভিন্ন সময়ে নিষেধাজ্ঞা বহাল রাখার কথা বলছেন দুই দেশের মৎস্যজীবীরা। মৎস্য ও পশুসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব সাঈদ মাহমুদ বেলাল হায়দরের ভাষ্য হলো, সাগরের তাপমাত্রা বৃদ্ধি বা জলবায়ু পরিবর্তনের মতো বিষয়গুলোর বাস্তবতা মেনে বাংলাদেশে চালু থাকা নিষেধাজ্ঞার সময় নিয়ে নতুন করে ভাবার সময় এসেছে।

চাঁদপুরের কান্ট্রি ফিশিং বোট মালিক সমিতির সভাপতি শাহ আলম মল্লিকের মতে, ‘আমাদের দুই দেশের নিষেধাজ্ঞার সময় যদি মেলানো না যায়, তবে আমাদের ইলিশের উৎপাদনে ধস নামবে।’ সে ক্ষেত্রে সরকারের উচিত ভারতের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক আলোচনা শুরু করা। বাংলাদেশ উপকূলে ৮০ শতাংশ ইলিশ ধরা পড়ে, অতএব নিষেধাজ্ঞার বিষয়েও বাংলাদেশের অগ্রাধিকার থাকা প্রয়োজন।

কিন্তু সমস্যা হলো, আমাদের কর্মকর্তারা বিষয়টি নিয়ে ভারতীয় পক্ষের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক কোনো আলোচনা শুরুই করেননি। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেছেন, ভারতীয় হাইকমিশনার একবার মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে এলে তিনি অনানুষ্ঠানিকভাবে বিষয়টি তুলেছিলেন।

অনানুষ্ঠানিকভাবে তুললেই দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। বাংলাদেশ ও ভারতের মৎস্যজীবীদের ইলিশের উৎস বঙ্গোপসাগর। এক অংশে মাছ ধরা বন্ধ থাকলে অন্য অংশে বেশি মাছ ধরা পড়ার সম্ভাবনা থাকে। এই সহজ সত্যটি নীতিনির্ধারকদের বুঝতে হবে।

অভিন্ন সময়ে নিষেধাজ্ঞা থাকলে দুই দেশই উপকৃত হবে আশা করা যায়।