কী প্রয়োজনে ‘জনতার সরকার’

সম্পাদকীয়

সরকার তিন কোটি টাকা ব্যয়ে ‘জনতার সরকার’ নামে যে নতুন পোর্টাল তৈরি করেছে, তার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। প্রথম আলোর খবরে বলা হয়, তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিভাগের সংস্থা বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলের ‘বাংলাদেশ সরকারের জন্য নিরাপদ ই-মেইল ও ডিজিটাল লিটারেসি সেন্টার স্থাপন’ শীর্ষক প্রকল্পের অধীন ‘জনতার সরকার’ ওয়েব পোর্টালটি চালু করা হয়েছে।

আগে থেকেই সরকারের প্রতিটি মন্ত্রণালয় ও গুরুত্বপূর্ণ অফিসের নিজস্ব ওয়েবসাইট আছে, যেখানে সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড তুলে ধরার পাশাপাশি জনগণের মতামত দেওয়ারও সুযোগ আছে।

তাহলে নতুন করে আরেকটি ওয়েবসাইট কেন? বলা হয়েছে, সরকারের উন্নয়নকাজসহ নানা কর্মকাণ্ড সম্পর্কে মানুষের মতামত জানতে এই নতুন পোর্টাল করা হয়েছে। প্রথমে সরকারের ১১টি বিভাগ ও মন্ত্রণালয় নিয়ে চালু হবে। পরে অন্যান্য মন্ত্রণালয় ও বিভাগও অন্তর্ভুক্ত হবে।

ওয়েবসাইটটিতে সরকারের বিভিন্ন কাজ সম্পর্কে মানুষ মতামত জানাতে পারবে। তবে কোন কোন বিষয়ে মতামত জানানো যাবে, তা সরকার ঠিক করবে। মূল গলদটা এখানেই। জনগণ কী কী বিষয়ে মতামত জানাবে, সেটা যদি সরকার ঠিক করে দেয়, তাহলে তারা খোলামনে কিছু লিখতে বা বলতে পারবে না।

সরকারের ইচ্ছাপূরণের কিংবা প্রশংসা শোনার ওয়েবসাইট হলে এর থেকে জনগণ কোনোভাবেই উপকৃত হবে না। গণমাধ্যমে প্রতিদিন জনজীবনের সমস্যা তুলে ধরা হয়; এর মাধ্যমে তাদের মতামত ও অভাব-অভিযোগের বিষয়টিও উঠে আসে। সরকারের নীতিনির্ধারকেরা যদি এসব আদৌ আমলে নিতেন, তাহলে জনগণকে পদে পদে ভোগান্তির শিকার হতে হতো না। এর জন্য জনগণের করের টাকা খরচ করে আলাদা করে ওয়েবসাইট খোলারও দরকার ছিল না।

বাংলাদেশের নাগরিকদের যাবতীয় তথ্য সুরক্ষা করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। কিন্তু আমরা উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করছি, সরকার সব ক্ষেত্রে সেই সুরক্ষা দিতে পারছে না। অপরাধী চক্র হীন স্বার্থ উদ্ধারে অন্যের ছবি ও পরিচয় ব্যবহার করে ভুয়া পরিচয়পত্র তৈরি করছে।

তথ্যপ্রযুক্তিবিদেরা প্রথম আলোকে প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে বলেছেন, মানুষের কী কী ব্যক্তিগত তথ্য নেওয়া হবে এবং তথ্যের গোপনীয়তা ও সুরক্ষা নীতিমালা অনুসরণ করা হচ্ছে কি না, তা দেখতে হবে। যে নীতিমালার আলোকে মন্তব্য মডারেট করা হবে, তাতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি না থাকলে জনগণের তথ্য লাভের অধিকার খর্ব হবে।

তথ্য ও প্রযুক্তি যোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ দাবি করেন, সরকারের কার্যক্রম তুলে ধরা ও সেখানে জনগণের মতামত জানতে ‘জনতার সরকার’ প্ল্যাটফর্ম।

কিন্তু ১ সেপ্টেম্বর তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিভাগের নিরাপত্তা এজেন্সির প্রশাসন শাখা থেকে পাঠানো নথিতে বলা হয়, ‘বাংলাদেশ সরকারের জন্য নিরাপদ ই-মেইল ও ডিজিটাল লিটারেসি সেন্টার স্থাপন প্রকল্পের জনতার সরকার এবং ডিজিটাল লিটারেসি সেন্টার কম্পোনেন্টকে ডিজিটাল লিটারেসি সেন্টার হিসেবে ডিজিটাল সিকিউরিটি এজেন্সি (ডিএসএ) ন্যস্তকরণের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ করা হলো।’

সে ক্ষেত্রে নতুন ওয়েবসাইটে যেসব নাগরিক মতামত জানাবেন, ভবিষ্যতে যে সেসব তাদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হবে না, তার নিশ্চয়তা কী? জনগণের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপনের জন্য সরকারের অনেক প্রকল্প আছে; যার বেশির ভাগই নিষ্ক্রিয় বা অকেজো।

এরপরও জনতার সরকার নামে আরেকটি ওয়েবসাইট খোলার যৌক্তিকতা আছে বলে মনে করি না। জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে নাগরিকদের মতামত জানার নামে নতুন ওয়েবসাইট তাদের সুলুকসন্ধান জানার ভিন্ন হাতিয়ার কি না, সেই প্রশ্নও উঠেছে।